পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনা brぬ একত্রে থাকিবার স্থান নাই; একত্রে থাকিলে সুবিধা হয় না ও বিভিন্ন চরিত্রের ব্যক্তি-সকল একত্রে থাকিলে পরস্পরের হানি হয়। কেহ যেন ইহাদের মধ্যে একটা মাত্র পরিবারকে দেখিয়া বিদ্যার বংশ কমিয়াছে বলিয়া না মনে করেন। বিদ্যার বংশ অত্যন্ত বাড়িয়াছে, একটা মাথায় তাহদের বাসস্থান কুলাইয়া উঠে না। আগে যাহারা ছোটাে ছিল এখন তাহারা বড়ো হইয়াছে। আগে যাহারা একা ছিল এখন তাহদের সন্তানাদি হইয়াছে। যখন জটিল লীলাময় গাঢ় বিচিত্র বেগবান মনোবৃত্তিসকল সভ্যতা-বৃদ্ধির সহিত, ঘটনাবৈচিত্র্যের সহিত, অবস্থার জটিলতার সহিত হৃদয়ে জন্মিতে থাকে তখন আর মহাকাব্যে পোষায় না। তখনকার উপযোগী মহাকাব্য লিখিয়া উঠাও এক জনের পক্ষে সম্ভবপর নহে। সুতরাং তখন খণ্ডকাব্য ও গীতিকাব্য আবশ্যক হয়। গীতিকাব্য মহাকাব্যের পূর্বেও ছিল কি না সে পরে আলোচিত হইবে। এক মহাকাব্যের মধ্যে সংক্ষেপে অপরিস্ফুট ভাবে অনেক গীতিকাব্য খণ্ডকাব্য থাকে, অনেক কবি সেইগুলিকে পরিস্ফুট করিয়াছেন। শকুন্তলা উত্তররামচরিত প্রভৃতি তাহার উদাহরণস্থল। গীতিকাব্য খণ্ডকাব্য যখন এত দূর বিস্তত হইয়া উঠে যে মহাকাব্যের অল্পায়তন স্থানে তাহারা ভালো স্মৃর্তি পায় না, তখন তাহারা পৃথক হইয়া পড়ে। অতএব ইহাতে কবিতার অশুভ আশঙ্কা করিবার কিছুই নাই। প্ৰথমে সৌরজগৎ একটি বাষ্পচক্র ছিল মাত্র, পরে তাহা হইতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইয়া গ্ৰহ উপগ্ৰহ সকল সুজিত হইল। এখনকার মতন তখন বৈচিত্র্য ছিল না। আমাদের এই বিচিত্ৰতাময় খণ্ড ও গীতি -কাব্য-সমাহের রাজ মাত্র সেই সব মহাকাব্যের মধ্যে ছিল ; কিন্তু তােহাঁই বলিয়া আমাদের মতো বসন্ত বর্ষা ছিল না; কানন পর্বত সমূদ্র ছিল না; পশু পক্ষী পতঙ্গ ছিল না; সকলেরই মূল কারণ মাত্র ছিল। এখন বিচ্ছিন্ন হইয়া সৌরজগৎ পরিপূর্ণতর হইয়াছে। ইহার কোনো অংশ সেই মহাসীেরচিক্রের সমান নহে বলিয়া কেহ যেন না বলেন যে জগৎ ক্রমশই অসম্পূর্ণতর হইয়া আসিয়াছে। এখন সৌরজগতের মহােৱ অনুধাবন করিতে হইলে এই বিচ্ছিন্ন। অথচ আকর্ষণ-সূত্রে বদ্ধ মহারাজ্যতন্ত্রকে একত্ৰ করিয়া দেখিতে হইবে; তাহা হইলে আর কাহারও সন্দেহ থাকিবে না যে এখনকার সৌরজগৎ পরিস্ফুটতর, উন্নততর। জগতেরও উন্নতিপর্যায়ের মধ্যে শ্রমবিভাগ আছে। সৌরজগতের কাজ এত বাড়িয়া গিয়াছে যে, পৃথক পৃথক হইয়া কাজের ভাগ না করিলে কোনো মতেই চলে না। যদি আধুনিক বিজ্ঞােনরাজ্যের সীমা ছাড়াইয়াও কিয়দদূর যাওয়া যায়, যদি এই একত্র-সম্মিলিত বাষ্পরাশিগত অবস্থার পূর্বেও আর কোনো অবস্থা থাকে এমন অনুমান করা যায়, তবে তাহা নানা স্বতন্ত্র আদিভূতসমূহের অস্ফুট ভাবে পৃথক ভাবে বিশৃঙ্খল সঞ্চরণ, পরস্পর সংঘর্ষ। যাহাকে ইংরাজিতে chaos বলিয়া থাকে। প্রথমে বিশৃঙ্খল পার্থক্য, পরে একত্র সম্মিলন, ও তাহার পরে শৃঙ্খলাবদ্ধ বিচ্ছেদ। আমাদের বুদ্ধির রাজ্যেও এই নিয়ম। প্রথমে কতকগুলা বিশৃঙ্খল পৃথক সত্য, পরে তাহদের এক-শ্রেণী-বদ্ধ করা, ও তৎপরে তাহাদের পরিস্ফুট বিভাগ। সমাজেও এই নিয়ম। প্ৰথমে বিশৃঙ্খল পৃথক পৃথক, ব্যক্তি, পরে তাহাদের এক শাসনে দৃঢ়রপে একত্রীকরণ, তাহার পরে প্রত্যেক ব্যক্তির অপেক্ষাকৃত ও যথোপযুক্ত পরিমাণে সুশৃঙ্খল স্বাতন্ত্র্য, সুসংযত স্বাধীনতা। কবিতাতেও এ নিয়ম খাটে। প্রথমে ছাড়া ছাড়া বিশৃঙ্খল অস্ফুট গীতোচ্ছাস, পরে পুঞ্জীভূত মহাকাব্য, তাহার পরে বিচ্ছিন্ন পরিস্ফুট গীতসমূহ। সৌরজগতের কবিতাকে যে ভাবে দেখা আবশ্যক, উন্নততর সাহিত্যের কবিতাকেও সেই ভাবে দেখা কর্তব্য। নাহিলে ভ্ৰমে পড়িতে হয়। সভ্যতার জোয়ারের মুখে সমস্ত সমাজ তীরের মতো অগ্রসর হইতেছে, কেবল কবিতাই যে উজলন বাহিয়া উঠিতেছে এমন কেহ না মনে করেন। এখন বিশেষ ব্যক্তির (individual) গুরুত্ব লোপ পাইতেছে বলিয়া কেহ যেন না মনে করেন যে, সংসার খাটো হইয়া আসিতেছে। কারণ Tennyson <s (572- "The individual withers and the world is more and more." একদল পণ্ডিত বলেন যে, যত দিন অজ্ঞানের প্রাদুর্ভাব থাকে তত দিন কবিতার শ্ৰীবৃদ্ধি হয়। অতএব সভ্যতার দিবসালোকে কবিতা ক্রমে ক্রমে অদৃশ্য হইয়া যাইবে। আচ্ছা, তাহাই মানিলাম। মনে করো কবিতা নিশাচর পক্ষী। কিন্তু কথা হইতেছে এই যে, জ্ঞানের অনুশীলন যতই হইতেছে অজ্ঞানের