পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VS8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বেমালুম বিলুপ্ত করে দিলে সে গল্প আজ একশো বছর ধরে ঘোষালদের ঘরে চলে আসছে। পুলিস যখন খানাতল্লাসি করতে এল নায়েব ভুবন বিশ্বাস অনায়াসে বললে, ই, সে কাছারিতে এসেছিল তার নিজের কাজে, হাতে পেয়ে বেটাকে কিছু অপমানও করেছি, শুনলেম নাকি সেই ক্ষোভে বিবাগি হয়ে চলে গেছে। হাকিমের সন্দেহ গেল না । ভুবন বললে, হুজুর, এই বছরের মধ্যে যদি তার ঠিকানা বের করে দিতে না পারি। তবে আমার নাম ভুবন বিশ্বাস নয় । কোথা থেকে দাশুর মাপের এক গুণ্ডা খুঁজে বার করলে- একেবারে তাকে পাঠালে ঢাকায় । সে করলে ঘটি চুরি, পুলিসে নাম দিলে দাশরথি মণ্ডল। হল এক মাসের জেলা। যে তারিখে ছাড়া পেয়েছে ভুবন সেইদিন মাজেস্টেরিতে খবর দিলে দাশু সর্দার ঢাকার জেলখানায় । তদন্তে বেরোল, দাশু জেলখানায় ছিল বটে, তার গায়ের দোলাইখানা জেলের বাইরের মাঠে ফেলে চলে গেছে। প্রমাণ হল সে দোলাই সর্দারেরই । তার পর সে কোথায় গেল। সে খবর দেওয়ার দায় ভুবনের নয়। এই গল্পগুলো দেউলে-হওয়া বর্তমানের সাবেক কালের চেক । গৌরবের দিন গেছে ; তাই গৌরবের পুরাতত্ত্বটা সম্পূর্ণ ফাঁকা বলে এত বেশি আওয়াজ করে। যা হােক, যেমন তেল ফুরোয়, যেমন দীপ নেবে, তেমনি এক সময়ে রাতও পোহায় । ঘোষাল-পরিবারে সূর্যোদয় দেখা দিল অবিনাশের বাপ মধুসূদনের জোর কপালে। ܔ মধুসূদনের বাপ আনন্দ ঘোষাল রাজবপুরের আড়তদারদের মুহুরি। মোটা ভাত মোটা কাপড়ে সংসার চলে। গৃহিণীদের হাতে শাখা-খাড়ু, পুরুষদের গলায় রক্ষামন্ত্রের পিতলের মাদুলি আর বেলের আটা দিয়ে মাজা খুব মোটা পইতে । ব্ৰাহ্মণ-মৰ্যাদায় প্রমাণ ক্ষীণ হওয়াতে পাইতেটা হয়েছিল প্ৰমাণসই । মফস্বল ইস্কুলে মধুসূদনের প্রথম শিক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে অবৈতনিক শিক্ষা ছিল নদীর ধারে, আড়াতের প্রাঙ্গণে, পাটের গাটের উপর চড়ে বসে। যাচনদার, খরিদদার, গোরুর গাড়ির গাড়োয়ানদের ভিড়ের মধ্যেই তার ছুটি- যেখানে বাজারে টিনের চালাঘরে সাজানো থাকে। সারবাধা গুড়ের কলসী, আঁটিবাধা তামাকের পাতা, গাটবাধা বিলিতি র্যাপার, কেরোসিনের টিন, সরষের ঢিবি, কলাইয়ের বস্তা, বড়ো বড়ো তীেল-দাড়ি আর বাটখারা, সেইখানে ঘুরে তার যেন বাগানে বেড়ানোর আনন্দ । বাপ ঠাওরালে ছেলেটার কিছু হবে । ঠেলেঠলে গোটা দুত্তিন পাস করতে পারলেই ইস্কুলমাস্টারি থেকে মোক্তারি ওকালতি পর্যন্ত ভদ্রলোকদের যে-কয়টা মোক্ষতীর্থ তার কোনো-না-কোনোটাতে মধু ভিড়তে পারবে । অন্য তিনটে ছেলের ভাগ্যসীমারেখা গোমস্তাগিরি পর্যন্তই পিলপে-গাড়ি হয়ে রইল । তারা কেউ-বা আড়তদারের, কেউ-বা তালুকদারের দফতরে কানে কলম গুজে শিক্ষানবিশিতে বসে গেল। আনন্দ ঘোষালের ক্ষীণ সর্বন্ধের উপর ভর করে মধুসূদন বাসা নিলে কলকাতার মেসে । অধ্যাপকেরা আশা করেছিল। পরীক্ষায় এ ছেলে কলেজের নাম রাখবে। এমন সময় বাপ গোল মারা । পড়বার বই, মায় নোটবই সমেত, বিক্রি করে মধুপণ করে বসল এবার সে রোজগার করবে। ছাত্রমহলে সেকেন্ড হ্যান্ড বই বিক্রি করে ব্যাবস্যা হল শুরু । মা কেঁদে মরে- বড়ো তার আশা ছিল, পরীক্ষাপাসের রাস্তা দিয়ে ছেলে ঢুকবে ‘ভাদোর শ্রেণীর ব্যুহের মধ্যে। তার পরে ঘোষাল-বংশদণ্ডের আগায় উড়বে কেরানিবৃত্তির জয়পতাকা । ছেলেবেলা থেকে মধুসূদন যেমন মাল বাছাই করতে পাকা, তেমনি তার বন্ধু বাছাই করবারও ক্ষমতা। কখনো ঠকে নি। তার প্রধান ছাত্ৰবন্ধু ছিল কানাই গুপ্ত। এর পূর্বপুরুষেরা বড়ো বড়ো সুপ্রিল মুম্বুদিরি করে এসেছে। বাপ নামজাদা কেরোদিন কােম্পািনর আপিস উচ্চ আসন @W5| ভাগ্যক্রমে এরই মেয়ের বিবাহ। মধুসূদন কোমরে চাদর বেঁধে কাজে লেগে গেল। চাল বাধা,