পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VoŠbr রবীন্দ্র-রচনাবলী আবাধানো, না গুড়গুড়ি। কর্তমহারাজের জন্যে বৃহৎ আলবোলা, গোলাপজলের গন্ধে সুগান্ধ । বাড়ির আর-এক মহলে বিলিতি বৈঠকখানা, সেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিলিতি আসবাব। সামনেই কালোদাগ-ধরা মস্ত এক আয়না, তার গিলটি-করা ফ্রেমের দুই গায়ে ডানাওয়ালা পরীমূর্তির হাতে-ধরা বাতিদান । তলায় টেবিলে সোনার জলে চিত্রিত কালো পাথরের ঘড়ি, আর কতকগুলো বিলিতি কঁচের পুতুল। খাড়া-পিঠওয়ালা চৌকি, সোফা, কড়িতে দোদূল্যমান ঝাড়লন্ঠন, সমস্তই হল্যান্ড-কাপড়ে মোড়া । দেয়ালে পূর্বপুরুষদের অয়েলপেন্টিং, আর তার সঙ্গে বংশের মুরুব্বি দু-একজন রাজপুরুষের ছবি। ঘরজোড়া বিলিতি কাপেট, তাতে মোটা মোটা ফুল টকটকে করা রঙে আঁকা। বিশেষ ক্রিয়াকর্মে জিলার সাহেব সুবাদের নিমন্ত্রণোপলক্ষে এই ঘরের অবগুণ্ঠন মোচন হয় । বাড়িতে এই একটা মাত্র আধুনিক ঘর, কিন্তু মনে হয় এইটেই সব চেয়ে প্রাচীন ভূতে-পাওয়া কামরা, অব্যবহারের রুদ্ধ ঘনগন্ধে দম-আটকানো দৈনিক জীবনযাত্রার সম্পর্কবঞ্চিত বোবা । মুকুন্দলালের যে শৌখিনতা সেটা তখনকার আদবাকায়দার অত্যাবশ্যক অঙ্গ। তার মধ্যে যে | নিভীক ব্যয়বাহুল্য, সেইটোতেই ধনের মর্যাদা । অর্থাৎ ধন বোঝা হয়ে মাথায় চড়ে নি, পাদপীঠ হয়ে আছে পায়ের তলায়। এদের শৌখিনতার আমদরবারে দানদাক্ষিণ্য, খাসদরবারে ভোগবিলাস- দুই খুব টানা মাপের । এক দিকে আশ্রিতবাৎসল্যে যেমন অকৃপণতা, আর-এক দিকে ঔদ্ধত্যদমনে তেমনি অবাধ অধৈৰ্য । একজন হঠাৎ-ধনী প্রতিবেশী গুরুতর অপরাধে কর্তার বাগানের মালীর ছেলের কান মলে দিয়েছিল মাত্র ; এই ধনীর শিক্ষাবিধান-বাবদ যত খরচ হয়েছে, নিজের ছেলেকে কলেজ পার করতেও এখনকার দিনে এত খরচ করে না । অথচ মালীর ছেলেটাকেও অগ্রাহ্য করেন নি। চাবাঁকিয়ে তাকে শয্যাগত করেছিলেন । রাগের চোটে চাবুকের মাত্রা বেশি হয়েছিল বলে ছেলেটার উন্নতি হল । সরকারি খরচে পড়াশুনো করে সে আজ মোক্তারি করে । পুরাতন কালের ধনবানদের প্রথামত মুকুন্দলালের জীবন দুই-মহলা । এক মহলে গাৰ্হস্থ্য, আর-এক মহলে ইয়ারকি । অর্থাৎ এক মহলে দশকর্ম, আর-এক মহলে একাদশ অকর্ম। ঘরে আছেন ইষ্টদেবতা আর ঘরের গৃহিণী। সেখানে পূজা-অৰ্চনা, অতিথিসেবা, পালপার্বণ, ব্ৰত-উপবাস, কাঙালিবিদায়, ব্ৰাহ্মণভোজন, পাড়াপড়শি, গুরুপুরোহিত । ইয়ারমহল গৃহসীমার বাইরেই, সেখানে নবাবি আমল, মজলিসি সমারোহে সরগরম। এইখানে আনাগোনা চলত গৃহের প্রত্যন্তপুরবাসিনীদের । তাদের সংসৰ্গকে তখনকার ধনীরা সহবত শিক্ষার উপায় বলে গণ্য করত। দুই বিরুদ্ধ হাওয়ার দুইকক্ষবতী গ্ৰহ-উপগ্রহ নিয়ে গৃহিণীদের বিস্তর সহ্য করতে হয়। মুকুন্দলালের স্ত্রী নন্দরানী অভিমানিনী, সহ্য করাটা তীর সম্পূর্ণ অভ্যাস হল না। তার কারণ ছিল। তিনি নিশ্চিত জানেন, বাইরের দিকে তার স্বামীর তানের দৌড় যতদূরই থাক, তিনিই হচ্ছেন্ন ধুয়ো, ভিতরে শক্ত টান তারই দিকে । সেইজন্যেই স্বামী যখন নিজের ভালোবাসার পরে নিজে অন্যায় করেন, তিনি সেটা সইতে পারেন না । এবার তাই ঘটল । (? রাসের সময় খুব ধুম । কতক কলকাতা, কতক ঢাকা থেকে আমোদের সরঞ্জাম এল। বাড়ির উঠোনে কৃষ্ণযাত্রা, কোনোদিন বা কীর্তন । এইখানে মেয়েদের ও সাধারণ পাড়াপড়শির ভিড় । অন্যবারে তামসিক আয়োজনটা হত বৈঠকখানা ঘরে ; অন্তঃপুরিকারা, রাতে ঘুম নেই, বুকে ব্যথা বিধছে, দরজার ফাক দিয়ে কিছু-কিছু আভাস নিয়ে যেতে পারতেন । এবারে খেয়াল গেল বাইনাচের ব্যবস্থা হবে বজরায় নদীর উপর । 萨 কী হচ্ছে দেখবার জো নেই বলে নন্দরানীর মন রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে আছড়ে আছড়ে কঁদতে লাগল। ঘরে কাজকর্ম, লোককে খাওয়ানো-দাওয়ানো, দেখাশুনো হাসিমুখেই করতে হয়। বুকের মধ্যে কিটাটা নড়তে চড়তে কেবলই বেঁধে, প্ৰাণটা ইপিয়ে ইপিয়ে ওঠে, কেউ জানতে পারে না । ও