পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ V8S সবাই বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে। মেয়েদের রাগ তারই পরে। ওরই জন্যে পূর্বপুরুষের মাথা যে হেট হল। রাজরানী হতে চলেছেন ! কী যে রাজার ছিরি ! জাতকুলের কথাটাকে কুমু তার ভক্তি দিয়ে চাপা দিয়েছিল। কিন্তু ধনের বড়াই করে শ্বশুরকুলকে খাটো করার নীচতা দেখে তার মন বিষাদে ভরে উঠল । কেবলই লোকের কাছ থেকে সে পালিয়ে বেড়ায় । ঘোষালদের লজ্জায় আজ যে ওরই লজ্জা । দাদার মুখ থেকে কিছু শোনবার জনো মনটা চট্টফট করছে। কিন্তু দাদার দেখা নেই, অন্দরমহলে খেতেও আসে না। একদিন বিপ্রদাস অন্তঃপুরের বাগানে ভিয়েনঘরের জন্যে চালা বঁধবার জায়গা ঠিক করতে গিয়ে হঠাৎ খিড়কির পুকুরের ঘাটে দেখে, কুমু নীচের পৈঠের উপর বসে মাথা হেঁট করে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। দাদাকে দেখে তাড়াতাড়ি উপরে উঠে এল । এসেই রুদ্ধস্বরে বললে, “দাদা, কিছুই বুঝতে পারছি নে ৷” বলেই মুখে কাপড় দিয়ে কেঁদে উঠল। দাদা ধীরে ধীরে পিঠে হাত বুলিয়ে বললে, “ লোকের কথায় কান দিস নে বোন ।” “কিন্তু ওঁরা এ-সব কী করছেন ? এতে কি তোমাদের মান থাকবে ?” “ওদের দিকটাও ভেবে দেখিস । পূর্বপুরুষের জন্মস্থানে আসছে, ধুমধাম করবে না ? বিয়ের ব্যাপার থেকে এটাকে স্বতন্ত্র করে দেখিস ।” কুমু চুপ করে রইল। বিপ্রদাস থাকতে পারলে না, মরিয়া হয়ে বললে, “তোর মনে যদি একটুও খটকা থাকে বিয়ে এখনাে ভেঙে দিতে পারি।” কুমুদিনী সবেগে মাথা নেড়ে বললে, “ছি ছি, সে কি হয় ?” অন্তর্যামীর সামনে সত্যগ্রন্থিতে তো গাঠ পড়ে গেছে। বাকি যেটুকু সে তো বাইরের | বিপ্রদাসের একেলে মন এতটা নিষ্ঠায় অধৈৰ্য হয়ে ওঠে । সে বললে, “দুই পক্ষের সততায় তবেই বিবাহবন্ধন সত্য। সুরে-বাধা এসরাজের কোনো মানেই থাকে না। যদি বাজাবার হাতটা হয় বেসুরো । পুরাণে দেখ না, যেমন সীতা তেমনি রাম, যেমন মহাদেব তেমনি সতী, অরুন্ধতী যেমন বশিষ্ঠও তেমনি । হাল-আমলের বাবুদের নিজেদের মধ্যে নেই পুণ্য, তাই একতরফা সতীত্ব প্রচার করেন । তাদের তরফে তেল জোটে না, সালতেকে বলেন জুলতে- শুকনো প্ৰাণে জ্বলতে জ্বলতেই ওরা গোল ছাই হয়ে ।” কুমুকে বলা মিথ্যে । এখন থেকে ও মনে মনে জোরের সঙ্গে জপতে লাগল, তিনি ভালোই হন, মন্দই হন, তিনি আমার পরম গতি । দুঃখেধনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহঃ বীতরাগভয়ক্রোধঃ- 贴" শুধু যতিধর্মের নয়, সতীধর্মেরও এই লক্ষণ । সে ধর্ম সুখদুঃখের অতীত— তাতে ক্ৰোধ নেই, ভয় নেই। আর অনুরাগ ? তারই বা অত্যাবশ্যকতা কিসের ? অনুরাগে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব থাকে, ভক্তি তারও বড়ো । তাতে আবেদন নেই, নিবেদন আছে। সতীধর্ম নৈর্ব্যক্তিক, যাকে ইংরেজিতে বলে ইস্পার্সেনাল। মধুসূদন-ব্যক্তিটিতে দোষ থাকতে পারে, কিন্তু স্বামী-নামক ভাব-পদার্থটি নির্বিকার নিরঞ্জন । সেই ব্যক্তিকতাহীন ধ্যানরূপের কাছে কুমুদিনী একমন হয়ে নিজেকে সমর্পণ করে দিলে । Σ8 ঘোষালদিঘির ধারে জঙ্গল সাফ হয়ে গেল।-- চেনা যায় না। জমি নিখুঁতভাবে সমতল, মাঝে মাঝে সুরকি দিয়ে রাঙানো রাস্তা, রাস্তার ধারে ধারে আলো দেবার থাম । দিঘির পানা সব তোলা হয়েছে। ঘাটের কাছে তকতকে নতুন বিলিতি পাল-খেলাবার দুটি নীেকো, তাদের একটির গায়ে লেখা 'মধুমতী', আর-একটির গায়ে ‘মধুকরী"। । যে তাঁবুতে রাজাবাহাদুর স্বয়ং থাকবেন তার সামনে ফ্রেমে হলদে বনাতের উপর লাল রেশমে বোনা ‘মধুচক্ৰ' । একটা তাবু অন্তঃপুরের, সেখান থেকে জল পর্যন্ত