পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ MSD 8 No সবই সত্য, কিন্তু যুক্তির দ্বারা সংসারে দুঃখ ঠেকানো যায় না। কুমুর প্রতি বিপ্ৰদাসের গভীর স্নেহ ; পাছে তাকে কিছুতে আঘাত করে এ কথাটা সকল তর্ক ছাড়িয়ে যায় । মেয়েদের পীড়ন করা এতই সহজ ; তাদের মর্মস্থান চার দিকেই অনাবৃত। জবরদস্তের হাতেই সমাজ চাবুক জুগিয়েছে ; আর যারা বর্মহীন তাদের স্পর্শকাতর পিঠের দিকে কোনো বিধিবিধান নজর করে না । এমন অবস্থায় স্নেহের ধনকে রোষ-বিদ্বেষ-ঈর্ষার তুফানে ভাসিয়ে দিয়ে নিজের অভিমান বঁাচাবার চেষ্টা করা কাপুরুষতা, বিপ্ৰদাসের মনের এই ভাব । বিপ্ৰদাস কাউকে না জানিয়ে ঘোড়ায় চড়ে গেল স্টেশনে । গাড়ি এসে পীেছল, তখন বেলা পাঁচটা । সেলুন-গাড়ি থেকে রাজা নামল দলবল নিয়ে । বিপ্রদাসকে দেখে শুষ্ক সংক্ষিপ্ত নমস্কার করে বললে, “এ কী, আপনি কেন কষ্ট করে ?” বিপ্ৰদাস | বিলক্ষণ ! এই প্ৰথম আসা আমার দেশে, অভ্যর্থনা করে নেব না ? রাজা । ভুল করছেন । আপনার দেশে এখনো আসি নি। সে হবে বিয়ের দিনে । বিপ্ৰদাস কথাটার মানে বুঝতে পারলে না । স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে তর্ক করবার জায়গা নয়- তাই রাজা বললে, “দরকার হবে না, আমাদের স্টীমলঞ্চ এসেছে।” বিপ্রদাস বুঝলে সুবিধে নয়। তবু আর-একবার বললে, “খাওয়া-দাওয়ার জিনিসপত্র, রসুইয়ের নীেকো সমস্তই প্ৰস্তুত ।” “কেন এত উৎপাত করলেন ! কিছুই দরকার হবে না । দেখুন, একটা কথা মনে রাখবেন, এসেছি আমার পূর্বপুরুষদের জন্মভূমিতে- আপনাদের দেশে না । বিয়ের দিনে সেখানে যাবার কথা ।” বিপ্রদাস বুঝলে কিছুতেই নরম হবার আশা নেই। বুকের ভিতরটা দমে গেল। স্টেশনের বসবার ঘরে কেদারায় গিয়ে শুয়ে পড়ল ৷ শীতের সন্ধ্যা, অন্ধকার হয়ে এসেছে । উত্তর থেকে গাড়ি আসবার জন্যে ঘণ্টা পড়ল, স্টেশনে আলো জ্বলল- লাগাম ছেড়ে ঘোড়াকে নিজের মরজিমত চলতে দিয়ে বিপ্রদাস যখন বাড়ি ফিরলে তখন যথেষ্ট রাত । কোথায় গিয়েছিল, কী ঘটেছিল, কাউকে কিছুই বললে ୩ | সেইদিন রাত্রে ওর ঠাণ্ড লেগে কাশি আরম্ভ হল, । ক্রমেই চলল বেড়ে । উপেক্ষা করতে গিয়ে ব্যামোটাকে আরো উসকে তুললে । শেযকালে কুমু ওকে অনেক ধরে কয়ে এনে বিছানায় শোওয়ায় । অনুষ্ঠানের সমস্ত ভারই পড়ল। নবগোপালের উপর । 2 ܠ দুদিন পরেই নবগোপাল এসে বললে, “কী করি একটা পরামর্শ দাও।” বিপ্ৰদাস ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “কেন ? কী হয়েছে ?” ጎጎ “সঙ্গে গোটাকতক সাহেব- দালাল হবে, কিংবা মদের দোকানের বিলিতি শুড়ি-কাল পীরপুরের চরের থেকে কিছু না হবে তো দুশো। কাদাখোচা পাখি মেরে নিয়ে উপস্থিত । আজ চলেছে চন্দনন্দহের বিলে । এই শীতের সময় সেখানে ইহাসের মরসুম- রাক্ষ্মসে ওজনের জীবহত্যা হবে- অহিরাবণ মহীরাবণ হিড়িম্বা ঘটােৎকচ ইস্তিক কুম্ভকর্ণের পর্যন্ত পিণ্ডি দেবার উপযুক্ত, প্রেতলোকে দশমুণ্ড রাবণের চোয়াল ধরে যাবার মতো ।” বিপ্রদাস স্তম্ভিত হয়ে রইল, কিছু বললে না । নবগোপাল বললে, “তোমারই হুকুম ঐ বিলে কেউ শিকার করতে পাবে না । সেবার জেলার ম্যাজিষ্ট্রেটকে পর্যন্ত ঠেকিয়েছিলে- আমরা তো ভয় করেছিলুম তোমাকেও পাছে সে রাজহাঁস ভুল করে গুলি করে বসে। লোকটা ছিল ভদ্র, চলে গেল। কিন্তু এরা গো-মৃগা-দ্বিজ কাউকে মানবার মতো মানুষ নয় । তবু যদি বল তো একবার না হয় বিপ্রদাস ব্যস্ত হয়ে বলে, “না না, কিছু বোলো না।”