পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ & 86. থেকে থেকে উদবিগ্নমুখে রাজাবাহাদুরের কানের কাছে ফিসফিস করে জানাচ্ছে এখনো খাবার লোক যথেষ্ট এল না । আজ হাটের দিন, ভিন্ন এলেকা থেকে যারা হাট করতে এসেছে তাদের কেউ কেউ পাত-পাড়া দেখে বসে গেছে। কাঙাল-ভিক্ষুকও সামান্য কয়েকজন আছে ! মধুসূদন নির্জন তীবুর ভিতর ঢুকে মুখ অন্ধকার করে একটা চাপা হুংকার দিলে- “হঁ।” ছোটো ভাই রাধু এসে বললে, “দাদা, আর কেন ? চলো ।” “কোথায় ?” “ফিরে যাই কলকাতায় । এরা সব বদমাইশি করছে। এদের চেয়ে বড়ো বড়ো ঘরের পাত্রী তোমার কড়ে আঙুল নাড়ার অপেক্ষায় বসে। একবার তু করলেই হয়।” মধুসূদন গর্জন করে উঠে বললে, “যা চলে।” একশো বছর পূর্বে যেমন ঘটেছিল আজও তাই । এবারেও এক পক্ষের আড়ম্বরের চূড়োটা অন্য পক্ষের চেয়ে অনেক উচু করেই গড়া হয়েছিল, অন্য পক্ষ তা রাস্তা পার হতে দিলে না । কিন্তু আসল হারজিত বাইরে দেখা যায় না । তার ক্ষেত্রটা লোকচক্ষুর অগোচরে । চাটুজ্যেদের প্রজারা খুব হেসে নিলে । বিপ্রদাস রোগশয্যায় ; তার কানে কিছুই পীেছল না । Sq বিয়ের দিন রাজার হুকুম, কনের বাড়ি যাবার পথে ধুমধাম একেবারেই বন্ধ । আলো জ্বলল না, বাজনা বাজল না, সঙ্গে কেবল নিজেদের পুরোহিত, আর দুইজন ভাট। পালকিতে করে নিঃশব্দে বিয়েবাড়িতে বর এল, লোকে হঠাৎ বুঝতেই পারলে না। ও দিকে মধুপুরীর তীবুতে আলো জ্বালিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে বিপরীত হৈ হৈ শব্দে বরযাত্রীর দল আহারে আমোদ প্রবৃত্ত । নবগোপাল বুঝলে এটা হল পালটা জবাব । এমন স্থলে কন্যাপক্ষ হাতে পায়ে ধরে বরপক্ষের সাধ্যসাধনা করে ; নবগোপাল তার কিছুই করলে না । একবার জিজ্ঞাসাও করলে না, বরযাত্রীদের হল কী । কুমুদিনী সাজসজ্জা করে বিবাহ-আসরে যাবার আগে দাদাকে প্ৰণাম করতে এল ; তার সর্বশরীর কঁপিছে। বিপ্রদাসের তখন একশো পঁাচ ডিগ্রি জুর, ব্লকে পিঠে রাইসরষের পলস্তারা ; কুমুদিনী তার পায়ের উপর মাথা ঠেকিয়ে আর থাকতে পারলে না, ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। ক্ষেমপিসি মুখে হাত চাপা দিয়ে বললে, “ছি ছি, আমন করে কঁদতে নেই ।” বিপ্রদাস একটু উঠে বসে ওকে হাত ধরে পাশে বসিয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল— দুই চােখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। ক্ষেমাপিসি বললে, “সময় হল যে ।” বিপ্রদাস কুমুর মাথায় হাত দিয়ে রুদ্ধকণ্ঠে বললে, “সর্বশুভদাতা কল্যাণ করুন।” বলেই ধাপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল । বিবাহের সমস্তক্ষণ কুমুর দু চােখ দিয়ে কেবল জল পড়েছে। বরের হাতে যখন হাত দিলে সে হাত ঠাণ্ডা হিম, আর থারথার করে কঁপিছে। শুভদৃষ্টির সময় সে কি স্বামীর মুখ দেখেছে ? হয়তো দেখে নি। এদের ব্যবহারে সবসুদ্ধ জড়িয়ে স্বামীর উপর ওর ভয় ধরে গেছে। পাখির মনে হচ্ছে তার জন্যে বাসা নেই, আছে। ফাস । A. মধুসূদন দেখতে কুশ্ৰী নয়। কিন্তু বড়ো কঠিন। কালো মুখের মধ্যে যেটা প্রথমেই চােখে পড়ে সে হচ্ছে পাখির চঞ্চুর মতো মস্ত বড়ো বঁকা নাক, ঠোঁটের সামনে পর্যন্ত বুকে পড়ে যেন পাহারা দিচ্ছে। প্রশস্ত গড়ানে কপাল ঘন ভ্রর উপর বাধাপ্রাপ্ত স্রোতের মতো স্ফীত । সেই ভুর ছায়াতলে সংকীর্ণ তির্যক চক্ষুর দৃষ্টি তীব্ৰ। গোফদাড়ি কামানো, ঠোঁট চাপা, চিবুক ভারী। কড়া চুল কাফ্রিদের মতো কোকড়া, মাথার তেলো ঘেঁষে ছটা। খুব আঁটর্সাট শরীর ; যত বয়েস তার চেয়ে কম বোধ হয়, কেবল দুই রাগের কাছে চুলে পাক ধরেছে। বেঁটে, মাথায় প্রায় কুমুদিনীর সমান । হাত দুটাে রোমশ ও দেহের তুলনায় খাটাে। সবসুদ্ধ মনে হয় মানুষটা একেবারে নিরেট ; মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বদাই কী একটা প্ৰতিজ্ঞা যেন গুলি পাকিয়ে আছে। যেন ভাগ্যদেবতার কামান থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে একাগ্রভাবে চলেছে