পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8V রবীন্দ্র-রচনাবলী একটা একওঁয়ে গোলা । দেখলেই বোঝা যায়, বাজে কথা বাজে বিষয় বাজে মানুষের প্রতি মন দেবার ওর একটুও অবকাশ নেই। y বিবাহটিা এমন ভাবে হল যে, সকলেরই মনে খারাপ লাগল । বরপক্ষ-কন্যাপক্ষের প্রথম সংস্পৰ্শমাত্রই এমন একটা বেসুর ঝনঝনিয়ে উঠল যে, তার মধ্যে উৎসবের সংগীত কোথায় গেল তলিয়ে | থেকে থেকে কুমুর মনের একটা প্রশ্ন অভিমানে বুক ঠেলে ঠেলে উঠছে, “ঠাকুর কি তবে আমাকে ভোলালেন?? সংশয়কে প্ৰাণপণে চাপা দেয়, রুদ্ধঘরের মধ্যে একলা বসে বার বার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্ৰণাম করে ; বলে, মন যেন দুর্বল না হয়। সব চেয়ে কঠিন হয়েছে দাদার কাছে সংশয় লুকোনো ! মায়ের মৃত্যুর পর থেকে কুমুদিনীর সেবার পরেই বিপ্রদাসের একান্ত নির্ভর । কাপড়াচোপড়, রক্ষণ, সংগীতযন্ত্রের পর্যবেক্ষণ, শোবার বসবার ঘরের পারিপাট্যসাধন— সমস্ত কুমুর হাতে । এত বেশি অভ্যাস হয়ে এসেছে যে, প্রাত্যহিক ব্যবহারে কুমুর হাত কোথাও না থাকলে তার রোচে না । সেই দাদার রোগশয্যায় বিদায়ের আগে শেষ কয়দিন যে সেবা করতে হয়েছে তার মধ্যে নিজের ভাবনার কোনো ছায়া না পড়ে এই তার দুঃসাধ্য চেষ্টা । কুমুর এসরাজের হাত নিয়ে বিপ্রদাসের ভারী গর্ব । লাজুক কুমু সহজে বাজাতে চায় না। এই দুদিন সে আপনি যেচে দাদাকে কানাড়া-মালকোষের আলাপ শুনিয়েছে | সেই আলাপের মধ্যেই ছিল তার দেবতার স্তব, তার প্রার্থনা, তার আশঙ্কা, তার আত্মনিবেদন । বিপ্রদাস চোখ বুজে চুপ করে শোনে আর মাঝে মাঝে ফরমাশ করে- সিন্ধু, বেহাগ, ভৈরবী— যে-সব সুরে বিচ্ছেদ-বেদনার কান্না বাজে । সেই সুরের মধ্যে ভাইবোন দুজনেরই ব্যথা এক হয়ে মিশে যায় । মুখের কথায় দুজনে কিছুই বললে না ; না দিলে পরস্পরকে সান্তনা, না জানালে पू६२ ।। বিপ্রদাসের জ্বর, কাশি, বুকে ব্যথা সারল না— বরং বেড়ে উঠছে। ডাক্তার বলছে ইনফ্লুয়েঞ্জা, হয়তো নুমোনিয়ায় গিয়ে পৌঁছতে পারে, খুব সাবধান হওয়া চাই। কুমুর মনে উদবেগের সীমা নেই। কথা ছিল বাসি-বিয়ের কালরাত্রিটা এখানেই কাটিয়ে দিয়ে পরদিন কলকাতায় ফিরবে। কিন্তু শোনা গেল মধুসূদন হঠাৎ পণ করেছে, বিবাহের পরদিনে ওকে নিয়ে চলে যাবে। বুঝলে, এটা প্রথার জন্যে নয়, প্রয়োজনের জন্যে নয়, প্রেমের জন্যে নয়, শাসনের জন্যে। এমন অবস্থায় অনুগ্রহ দাবি করতে অভিমানিনীর মাথায় বজাঘাত হয় । তবু কুমু মাথা হেঁট করে লজ্জা কাটিয়ে কম্পিত্যকণ্ঠে বিবাহের রাতে স্বামীর কাছে এইমাত্র প্রার্থনা করেছিল যে, আর দুটাে দিন যেন তাকে বাপের বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়, দাদাকে একটু ভালো দেখে যেন সে যেতে পারে। মধুসূদন সংক্ষেপে বললে, “সমস্ত ঠিকঠাক হয়ে গেছে।” এমন বজে-বাধা একপক্ষের ঠিকঠাক, তার মধ্যে কুমুর মর্মান্তিক বেদনারও এক তিল স্থান নেই। তার পর মধুসূদন ওকে রাত্রে কথা কওয়াতে চেষ্টা করেছে, ও একটিও জবাব দিল না- বিছানার প্রান্তে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইল । তখনো অন্ধকার, প্রথম পাখির দ্বিধাজড়িত কাকলি শোনাবামাত্র ও বিছানা ছেড়ে চলে গেল । বিপ্রদাস সমস্ত রাত ছটফট করেছে। সন্ধ্যার সময় জ্বর-গায়েই বিবাহসভায় যাবার জন্যে। ওর ঝোক হল। ডাক্তার অনেক চেষ্টায় চেপে রেখে দিলে। ঘন ঘন লোক পাঠিয়ে সে খবর নিয়েছে। খবরগুলো যুদ্ধের সময়কার খবরের মতো, অধিকাংশই বানানো । বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করলে, “কখন বর এল ? বাজনাবান্দ্যির আওয়াজ তো পাওয়া গেল না ।” সংবাদদাতা শিবু বললে, “আমাদের জামাই বড়ো বিবেচক- বাড়িতে অসুখ শুনেই সব থামিয়ে দিয়েছে- বরযাত্রদের পায়ের শব্দ শোনা যায় না, এমনি ঠাণ্ডা।” “ওরে শিবু, খাবার জিনিস তো কুলিয়েছিল ? আমার ঐ এক ভাবনা ছিল, এ তো কলকাতা নয় !" “কুলোয় নি ? বলেন কী হুজুর ! কত ফেলা গেল ! আরো অতগুলো লোককে খাওয়াবার মতো জিনিস বাকি আছে।”