পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ \93Գ

  • ওরা খুশি হয়েছে তো ?” “একটি নালিশ কারও মুখে শোনা যায় নি । একেবারে টু শব্দটি না । আরো তো এত এত বিয়ে দেখেছি, বরযাত্রের দাপাদাপিতে কন্যাকর্তার ভিমি লাগে । এরা এমনি চুপ, আছে কি না-আছে বোঝাই যায় না ।”

বিপ্ৰদাস বললে, “ওরা কলকাতার লোক কিনা, তাই ভদ্র ব্যবহার জানা আছে । ওরা বোঝে যে, যে বাড়ি থেকে মেয়ে নেবে তাদের অপমানে নিজেদেরই অপমান ।” “আহা, হুজুর যা বললেন, এই কথাটি ওদের লোকজনদের আমি শুনিয়ে দেব। শুনলে ওরা খুশি হবে ।” । কুমুকাল সন্ধের সময়েই বুঝেছিল অসুখ বাড়বার মুখে । অথচ সে যে দাদার সেবা করতে পারবে না। এই দুঃখ সৰ্বক্ষণ তার বুকের মধ্যে ফাদে-পড়া পাখির মতো ছটফট করতে লাগল। তার হাতের সেবা যে তার দাদার কাছে ওষুধের চেয়ে বেশি। স্নান করে ঠাকুরকে ফুল দিয়ে কুমু যখন দাদার ঘরে এল তখনো সূর্য ওঠেনি। কঠিন রোগের সঙ্গে অনেকক্ষণ লড়াই করে ক্ষণকাল ছুটি পাবার সময় যে অবসাদের বৈরাগ্য আসে। সেই বৈরাগ্যে বিপ্রদাসের মন তখন শিথিল। জীবনের আসক্তি, সংসারের ভাবনা সব তার কাছে শস্যশূন্য মাঠের মতো ধূসরবর্ণ। সমস্ত রাত দরজা বন্ধ ছিল, ডাক্তার ভোরের বেলায় পুব দিকের জানালাটা খুলে দিয়েছে। আশথগাছের শিশির-ভেজা পাতার আড়ালে অরুণবৰ্ণ আকাশের আভা ধীরে ধীরে শুভ্ৰ হয়ে আসছে— অদূরবতী নদীতে মহাজনি নীেকোর বৃহৎ তালি-দেওয়া পালগুলি সেই আরক্তিম আকাশের গায়ে স্ফীত হয়ে উঠল। নহবতে করুণ সুরে রামকেলি বাজছে। পাশে বসে কুমু নিজের দুই ঠাণ্ডা হাতের মধ্যে দাদার শুকনো গরম হাত তুলে নিলে । বিপ্রদাসের টেরিয়র কুকুর খাটের নীচে বিমর্ষ মনে চুপ করে শুয়ে ছিল । কুমু খাটে এসে বসতেই সে দাঁড়িয়ে উঠে দু পা তার কোলের উপর রেখে লেজ নাড়তে নাড়তে করুণ চোখে ক্ষীণ আর্তস্বরে কী যেন প্রশ্ন করলে | বিপ্ৰদাসের মনে ভিতরে ভিতরে কী একটা চিন্তার ধারা চলছিল, তাই হঠাৎ এক সময়ে অসংলগ্নভাবে বলে উঠল, “দিদি, আসলে কিছুই নয়- কে বড়ো কে ছোটাে, কে উপরে কে নীচে, এ সমস্তই বানানো কথা । ফেনার মধ্যে বুদবুদগুলোর কোনটার কোথায় স্থান তাতে কী আসে যায়। আপনার ভিতরে আপনি সহজ হয়ে থাকিস, কিছুতেই তোকে মারবে না।” মুম্বক আশীর্বর করে দাদা, আমাকে আশীৰ্বাদ করে" বলে কুমৃদু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্ন চাপা। বিপ্রদাস বালিশে ঠেস দিয়ে একটু উঠে বসে কুমুর মুখ নামিয়ে ধরে তার মাথায় চুমো খেলে । ডাক্তার ঘরে ঢুকে বললে, “আর নয় কুমুদিদি, এখন ষ্ট্রর একটু শান্ত থাকা দরকার।” কুমু রোগীর বালিশ একটু চেপে-চুপে ঠিক করে গায়ের উপর গরম কাপড়টা টেনে দিয়ে, পাশের টিপাইটার উপরকার বিশৃঙ্খলতা একটু সেরে নিয়ে দাদার কানের কাছে মৃদুস্বরে বললে, “সেরে গেলেই কলকাতায় যেয়ো দাদা, সেখানে তোমাকে দেখতে পাব ।” বিপ্রদাস বড়ো বড়ো দুই স্নিগ্ধ চোখ কুমুর মুখের উপর স্থির রেখে বললে, “কুমু, পশ্চিমের মেঘ যায় পুবে, পুবের মেঘ যায় পশ্চিমে, এ-সব হাওয়ায় হয়। সংসারে সেই হাওয়া বইছে। মেঘের মতোই অমনি সহজে এটাকে মেনে নিস দিদি । এখন থেকে আমাদের কথা বেশি ভাবিস নে । যেখানে যাচ্ছিস সেখানে লক্ষ্মীর আসন তুই জুড়ে থাকিস- এই আমার সকল মনের আশীর্বাদ । তোর কাছে আমরা আর কিছুই চাই নে ৷” দাদার পায়ের কাছে কুমু মাথা রেখে পড়ে রইল। “আজ থেকে আমার কাছে আর কিছুই চাবার নেই। এখানকার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় আমার কোনো হাতই থাকবে না- এক মুহুর্তে এতবড়ো বিচ্ছেদের কথা মেনে নেওয়া যায় না। ঝড়ে যখন নীেকাকে ডাঙা থেকে টেনে নিয়ে যায়। তখন নোঙর (Sv