পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ WGS কুমু চমকে উঠল । ওর দাদা যে স্টেশনে অভ্যর্থনা করতে গিয়েছিল সে খবর এই প্রথম শুনলে । “আহা, কী সুপুরুষ ! এমন কখনো চক্ষে দেখি নি। ঐ-যে গান শুনেছিলেম কীর্তনে গোরার রূপে লাগল। রসের বানভাসিয়ে নিয়ে যায় নদীয়ার পুরনারীর প্রাণ আমার তাই মনে পড়ল ।” মুহুর্তে কুমুর মন গলে গেল । মুখ আড় করে জানলার দিকে রইল চেয়ে- বাইরের মাঠ বন আকাশ অশ্রুবাম্পে ঝাপসা হয়ে গেল । মোতির মারি বুঝতে বাকি ছিল না কোন জায়গায় কুমুর দরদ, তাই নানারকম করে ওর দাদার কথাই আলোচনা করলে । জিজ্ঞাসা করলে বিয়ে হয়েছে কি না । কুমু বললে, “না।” মােতির মা বলে উঠল, “মরে যাই! অমন দেবতার মতো রূপ, এখনাে ঘর খালি ! কোন ভাগ্যবতীর কপালে আছে ঐ বর !” কুমু তখন ভাবছে- দাদা গিয়েছিলেন সমস্ত অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে, কেবল আমারই জন্যে ! তার পরে ঐরা একবার দেখতেও এলেন না ! কেবলমাত্র টাকার জোরে এমন মানুষকেও অবজ্ঞা করতে সাহস করলেন ! তীর শরীর এইজন্যেই বুঝি-বা ভেঙে পড়ল । বৃথা আক্ষেপের সঙ্গে বার বার মনে মনে বলতে লাগিল- দাদা কেন গেল ইস্টেশনে ? কেন নিজেকে খাটো করলে ? আমার জন্যে ? আমার মরণ হল না কেন ? যে কাজটা হয়ে গেছে, আর ফেরানো যাবে না, তারই উপর ওর মনটা মাথা ঠুকতে লাগল। কেবলই মনে পড়তে লাগল, সেই রোগে-ক্লান্ত শান্ত মুখ, সেই আশীর্বাদে-ভরা স্নিগ্ধগভীর দুটি চােখ । SO রেলগাড়ি হাওড়ায় পৌঁছল, বেলা তখন চারটে হবে । ওড়নায়-চাদরে গ্ৰন্থিবদ্ধ হয়ে বরকনে গিয়ে বসিল বুহাম গাড়িতে। কলকাতার দিবালোকের অসংখ্য চক্ষু, তার সামনে কুমুর দেহমান সংকুচিত হয়ে রইল। যে-একটি অতিশয় শুচিতাবোধ এই উনিশ বছরের কুমারীজীবনে ওরা অঙ্গে অঙ্গে গভীর করে ব্যাপ্ত, সেটা যে কর্ণের সহজ কবিচের মতো, কেমন করে ও হঠাৎ ছিন্ন করে ফেলবে ? এমন মন্ত্র আছে যে মন্ত্রে এই কবচ এক নিমেষে আপনি খসে যায় । কিন্তু সে মন্ত্র হৃদয়ের মধ্যে এখনো বেজে ওঠে নি। পাশে যে মানুষটি বসে আছে, মনের ভিতরে সে তো আজও বাইরের লোক । আপনি লোক হবার পক্ষে তার দিক থেকে কেবল তো বাধাই এসেছে । তার ভাবে ব্যবহারে যে একটা রূঢ়তা সে যে কুমুকে এখনো পর্যন্ত কেবলই ঠেলে ঠেলে দূরে ঠেকিয়ে রাখল। এ দিকে মধুসূদনের পক্ষে কুমু একটি নূতন আবিষ্কার। স্ত্রীজাতির পরিচয় পায় এ পর্যন্ত এমন অবকাশ এই কেজো মানুষের অল্পই ছিল । ওর পণ্যজগতের ভিড়ের মধ্যে পণ্য-নারীর ছোওয়াও ওকে কখনো লাগে নি। কোনো স্ত্রী ওর মনকে কখনাে বিচলিত করে নি। এ কথা সত্য নয়, কিন্তু ভূমিকম্প পর্যন্তই ঘটেছে- ইমারত জখম হয় নি। মধুসূদন মেয়েদের অতি সংক্ষেপে দেখেছে ঘরের বউঝিদের মধ্যে । তারা ঘরকন্নার কাজ করে, কেঁদেল করে, কানাকানি করে, অতি তুচ্ছ কারণে কান্নাকাটিও করে । থাকে। মধুসূদনের জীবনে এদের সংস্রব নিতান্তই যৎসামান্য । ওর স্ত্রীও যে জগতের এই অকিঞ্চিৎকর বিভাগে স্থান পাবে, এবং দৈনিক গাৰ্হস্থ্যের তুচ্ছতায় ছায়াচ্ছন্ন হয়ে প্রাচীরের আড়ালে কর্তাদের কটাক্ষচালিত মেয়েলি জীবনযাত্রা অতিবাহিত করবে। এর বেশি সে কিছুই ভাবে নি। স্ত্রীর সঙ্গে ব্যবহার করবারও যে একটা কলানৈপুণ্য আছে, তার মধ্যেও যে পাওয়ার বা হারাবার একটা কঠিন সমস্যা থাকতে পারে, এ কথা তার হিসাবদক্ষ সতর্ক মস্তিষ্কের এক কোণেও স্থান পায় নি ; বনস্পতির নিজের পক্ষে প্ৰজাপতি যেমন বাহুল্য, অথচ প্ৰজাপতির সংসৰ্গ যেমন তাকে মেনে নিতে হয়, ভাবী স্ত্রীকেও মধুসূদন তেমনি করেই ভেবেছিল।