পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OGS রবীন্দ্র-রচনাবলী এমন সময় বিবাহের পরে সে কুমুকে প্রথম দেখলে ৷ এক রকমের সৌন্দৰ্য আছে তাকে মনে হয় যেন একটা দৈব আবির্ভাব, পৃথিবীর সাধারণ ঘটনার চেয়ে অসাধারণ পরিমাণে বেশি- প্রতিক্ষণেই যেন সে প্রত্যাশার অতীত । কুমুর সৌন্দর্য সেই শ্রেণীর। ও যেন ভোরের শুকতারার মতো, রাত্রের জগৎ থেকে স্বতন্ত্র, প্ৰভাতের জগতের ও পারে। মধুসূদন তার অবচেতন মনে নিজের অগোচরে কুমুকে একরকম অস্পষ্টভাবে নিজের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বোধ করলে— অন্তত একটা ভাবনা উঠল এর সঙ্গে কী রকম ভাবে ব্যবহার করা চাই, কোন কথা কেমন করে বললে সংগত হবে। কী বলে আলাপ আরম্ভ করবে ভাবতে ভাবতে মধুসূদন হঠাৎ এক সময়ে কুমুকে জিজ্ঞাসা করলে, “এ দিক থেকে রোদন্দুর আসছে, না ?” । কুমু কিছুই জবাব করলে না । মধুসূদন ডান দিকের পর্দাটা টেনে দিলে। খানিকক্ষণ আবার চুপচাপ কাটল । আবার খামক বলে উঠল, “শীত করছে না তো ?” বলেই উত্তরের প্রতীক্ষা না করে সামনের আসন থেকে বিলিতি কম্বলটা টেনে নিয়ে কুমুর ও নিজের পায়ের উপর বিছিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে এক-আবরণের সহযোগিতা স্থাপন করলে। শরীর মন পুলকিত হয়ে উঠল। চমকে উঠে কুমুদিনী কম্বলটাকে সরিয়ে দিতে যাচ্ছিল, শেষে নিজেকে সংবরণ করে আসনের প্ৰান্তে গিয়ে সংলগ্ন হয়ে রইল । , কিছুক্ষণ এইভাবে যায় এমন সময় হঠাৎ কুমুর হাতের দিকে মধুসূদনের চােখ পড়ল । “দেখি দেখি” বলে হঠাৎ তার বা হাতটা চোখের কাছে তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করলে, “তোমার আঙুলে এ কিসের আংটি ? এ যে নীলা, দেখছি।” কুমু চুপ করে রইল । “দেখো, নীলা আমার সয় না, ওটা তোমাকে ছাড়তে হবে ।” কোনো এক সময়ে মধুসূদন নীলা কিনেছিল, সেই বছর ওর গাধাবোট-বোঝাই পাট হাওড়ার ব্রিজে ঠেকে তলিয়ে যায় । সেই অবধি নীলা-পাথরকে ও ক্ষমা করে না । কুমুদিনী আন্তে আস্তে হাতটাকে মুক্ত করতে চেষ্টা করলে। মধুসূদন ছাড়লে না ; বললে, “এটা আমি খুলে নিই।” কুমু চমকে উঠল ; বললে, “না, থাক ।” একবার দাবাখেলায় ওর জিত হয় ; সেইবার দাদা ওকে তার নিজের হাতের আংটি পারিতোষিক দিয়েছিল । মধুসূদন মনে মনে হাসলে। আংটির উপর বিলক্ষণ লোভ দেখছি। এইখানে নিজের সঙ্গে কুমুর সাধম্যের পরিচয় পেয়ে একটু যেন আরাম লাগল। বুঝলে, সময়ে অসময়ে সিঁথি কণ্ঠহার। বালা বাজুর যোগে অভিমানিনীর সঙ্গে ব্যবহারের সোজা পথ পাওয়া যাবে- এই পথে মধুসূদনের প্রভাব না মেনে উপায় নেই, বয়স না-হয় কিছু বেশিই হল । নিজের হাত থেকে মন্তবড়ো কমলহীরের একটা আংটি খুলে নিয়ে মধুসূদন হেসে বললে, “ভয় নেই, এর বদলে আর-একটা আংটি তোমাকে পরিয়ে দিচ্ছি।” কুমু আর থাকতে পারলে না, একটু চেষ্টা করেই হাত ছাড়িয়ে নিলে। এইবার মধুসূদনের মনটা বেঁকে উঠল। কর্তৃত্বের খর্বতা তাকে সইবে না, শুষ্ক গলায় জোর করেই বলল, “দেখো, এ আংটি তোমাকে খুলতেই হবে।” । কুমুদিনী মাথা হেঁট করে চুপ করে রইল, তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। মধুসূদন আবার বললে, “শুনিছ ? আমি বলছি। ওটা খুলে ফেলা ভালো। দাও আমাকে ৷” বলে হাতটা টেনে নিতে উদ্যত হল । কুমু হাত ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “আমি খুলছি।” খুলে ফেললে । “দাও, ওটা আমাকে দাও ।”