পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(2)(\ রবীন্দ্র-রচনাবলী চলে গেছে। সেই মনটাকে শাসন করবার একটুও সময় পাচ্ছিল না। ঠাকুর, বল দাও, বল দাও, আমার জীবন কালি করে দিয়ে না । আমি তোমার দাসী, আমাকে জয়ী করো, সে জয় তোমারই । পরিণতবয়সী আঁটর্সটি গড়নের শ্যামবর্ণ একটি সুন্দরী বিধবা ঘরে ঢুকেই বললে, “মোতির মা তোমাকে একটু ছুটি দিয়েছে সেই ফাকে এসেছি ; কাউকে তো কাছে ঘেঁষতে দেবে না, বেড়ে রাখবে তোমাকে- যেন সিধকাটি নিয়ে বেড়াচ্ছি, ওর বেড়া কেটে তোমাকে চুরি করে নিয়ে যাব । আমি তোমার জা, শ্যামাসুন্দরী ; তোমার স্বামী আমার দেওর। আমরা তো ভেবেছিলুম শেষ পর্যন্ত জমাখরচের খাতাই হবে ওর বউ । তা ঐ খাতার মধ্যে জাদু আছে ভাই, এত বয়সে এমন সুন্দরী ঐ খাতার জোরেই জুটল। এখন হজম করতে পারলে হয়। ঐখানে খাতার মন্তর খাটে না। সত্যি করে বলো ভাই, আমাদের বুড়ো দেওরটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো ?” কুমু অবাক হয়ে রইল, কী জবাব দেবে ভেবেই পেলে না । শ্যামা বলে উঠল, “বুঝেছি, তা পছন্দ না হলেই বা কী, সাত পাক যখন ঘুরেছ তখন একুশ পাক উলটাে ঘুরলেও ফাস খুলবে না।” कूशू दलाल, "6 की कथा दलछ निनि !” শ্যামা জবাব দিলে, “খোলসা করে কথা বললেই কি দোষ হয় বোন ? মুখ দেখে কি বুঝতে পারি নে ? তা দােষ দেব না তােমাকে । ও আমাদের আপনি বলেই কি চােখের মাথা খেয়ে বসেছি ? বড়ো শক্ত হাতে পড়েছ বউ, বুঝে সুঝে চোলো ।” এমন সময় মোতির মাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই বলে উঠল, “ভয় নেই, ভয় নেই, বকুলফুল, যাচ্ছি আমি । ভাবলুম তুমি নেই এই ফঁাকে আমাদের নতুন বউকে একবার দেখে আসি গে। তা সত্যি বটে, এ কৃপণের ধন, সাবধানে রাখতে হবে । সইকে বলছিলুম আমাদের দেওরের এ যেন হল আধ-কপালে মাথাধরা ; বউকে ধরেছে। ওর বা দিকের পাওয়ার-কপালে, এখন ডান দিকের রাখার-কপালে যদি এই বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুহুর্ত পরে ঘরে ঢুকে কুমুর সামনে পানের ডিবে খুলে ধরে বললে, “একটা পান নেও । দোক্তা খাওয়া অভ্যোস আছে ?” আিম বললে, "না |” তখন এক টিপ দোক্তা নিয়ে নিজের মুখে পুরে দিয়ে শ্যামা মন্দগমনে বিদায় “এখনই বন্দ্দিমাসিকে খাইয়ে বিদায় করে আসছি, দেরি হবে না” বলে মােতির মা চলে গেল। শ্যামাসুন্দরী কুমুর মনের মধ্যে ভারি একটা বিস্বাদ জাগিয়ে দিলে। আজকে কুমুর সব চেয়ে দরকার ছিল মায়ার আবরণ, সেইটেই সে আপন মনে গড়তে বসেছিল, আর যে-সৃষ্টিকর্তা দ্যুলোকে ভুলোকে নানা রঙ নিয়ে রূপের লীলা করেন, তাকেও সহায় করবার চেষ্টা করছিল, এমন সময় শ্যামা এসে ওর স্বপ্ন-বোনা জালে ঘা মারলে। কুমু চোখ বুজে খুব জোর করে নিজেকে বলতে লাগল, “স্বামীর বয়স বেশি বলে তঁকে ভালোবাসি নে এ কথা কখনোই সত্য নয়- লজা লাজ ! এ যে ইতর মেয়েদের মতো কথা।” শিবের সঙ্গে সতীর বিয়ের কথা কি ওর মনে নেই ? শিবনিন্দুকরা তার বয়স নিয়ে খোটা দিয়েছিল, কিন্তু সে কথা সতী কানে নেন নি । স্বামীর বয়স বা রূপ নিয়ে এ পর্যন্ত কুমু কোনো চিন্তাই করে নি। সাধারণত যে ভালোবাসা নিয়ে স্ত্রীপুরুষের বিবাহ সত্য হয়, যার মধ্যে রূপগুণ দেহমান সমস্তই মিলে আছে, তার যে প্রয়ােজন আছে। এ কথা কুমু ভাবেও নি। পছন্দ করে নেওয়ার কথাটাকেই রঙ মাখিয়ে চাপা দিতে চায়। এমন সময় ফুলকাটা জামা ও জরির পাড়ওয়ালা ধুতি-পরা ছেলে, বয়স হবে বছর সাতেক, ঘরে ঢুকেই গা ঘেঁষে কুমুর কাছে এসে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো স্নিগ্ধ চোখ ওর মুখের দিকে তুলে ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে মিষ্টি সুরে বললে, “জ্যাঠাইমা ।” কুমু তাকে কোলের উপর টেনে নিয়ে বললে, “কী বাবা, তোমার নাম ?” ছেলেটি খুব ঘটা করে বললে, শ্ৰীটুকুও বাদ দিলে না, “শ্ৰীমোতিলাল ঘোষাল ।” সকলের কাছে পরিচয় ওর হাবলু বলে। সেইজন্যেই উপযুক্ত দেশকলপাত্রে নিজের সম্মান রাখবার জন্যে পিতৃদত্ত নামটাকে এত সুসম্পূর্ণ করে বলতে হয়। তখন কুমুর বুকের ভিতরটা টনটন