পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ VGS নিবগোপাল বললে, “ও বাড়িতে তুমি গেলে আমাদের মান থাকবে না।” বিবাহরাত্রির কথা আজও সে ভুলতে পারে নি। তাই প্রায়-অসম্পৰ্কীয় গুটিকয়েক ছােটাে ছােটাে মেয়ে এক বুড়ি দাসীর সঙ্গে পাঠিয়ে দিলে নিমন্ত্রণ রাখতে । কুমু বুঝলে, সন্ধি এখনো হল না, হয়তো কোনো কালে হবে না । কুমুর সাজসজ্জা হল। ঠাট্টার সম্পৰ্কীয়দের ঠাট্টার পালা শেষ হয়েছে- নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানো শুরু হবে। মধুসূদন আগে থাকতেই বলে রেখেছিল, বেশি রাত করলে চলবে না, কাল ওর কাজ আছে। ন-টা বাজবা মাত্রই হুকুমমত নীচের উঠোন থেকে সশব্দে ঘণ্টা বেজে উঠল। আর এক মুহূর্ত না । সময় অতিক্রম করবার সাধ্য কারও নেই । সভা ভঙ্গ হল । আকাশ থেকে বাজপাখির ছায়া দেখতে পেয়ে কপোতীর যেমন করে, কুমুর বুকটা তেমনি কঁাপিতে লািগল । তার ঠাণ্ডা হাত ঘামছে, তার মুখ বিবর্ণ। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই মোতির মা'র হাত ধরে বললে, “আমাকে একটুখানির জন্যে কোথাও নিয়ে যাও আড়ালে। দশ মিনিটের জন্যে একলা থাকতে দাও ।” মোতির মা তাড়াতাড়ি নিজের শোবার ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলে। বাইরে দাড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললে, “এমন কপালও করেছিলি ।” দশ মিনিট যায়, পনেরো মিনিট যায় । লোক এল- বর শোবার ঘরে গেছে, বউ কোথায় ? মোতির মা বললে, “অত ব্যস্ত হলে চলবে কেন ? বউ গায়ের জামা-গয়নাগুলো খুলবে না ?” মোতির মা যতক্ষণ পারে ওকে সময় দিতে চায়। অবশেষে যখন বুঝলে আর চলবে না। তখন দরজা খুলে দেখে, বউ মূৰ্ছিত হয়ে মেজের উপর পড়ে আছে। গোলমাল পড়ে গেল। ধরাধরি করে বিছানার উপর তুলে দিয়ে কেউ জলের ছিটে দেয়, কেউ বাতাস করে । কিছুক্ষণ পরে যখন চেতনা হল, কুমু বুঝতে পারলে না কোথায় সে আছে- ডেকে উঠল, “দাদা ।” মোতির মা তাড়াতাড়ি তার মুখের উপর ঝুকে পড়ে বললে, “ভয় নেই দিদি, এই যে আমি আছি।” বলে ওর মুখটা বুকের উপর তুলে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। সবাইকে বললে, “তোমরা ভিড় কোরো না, আমি এখনই ওকে নিয়ে যাচ্ছি।” কানে কানে বলতে লাগল, “ভয় করিস নে ভাই, ভয় করিস নে ৷” কুমু ধীরে ধীরে উঠল । মনে মনে ঠাকুরের নাম করে প্রণাম করলে। ঘরের অন্য পাশে একটা তক্তাপোশের উপর হাবলু গভীর ঘুমে মগ্ন- তার পাশে গিয়ে তাঁর কপালে চুমো প্লা! মােক্তির মা তাকে শোবার ঘর পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “এখনো ভয় করছে। יי? কুমু হাতের মুঠো শক্ত করে একটু হেসে বললে, “না, আমার কিছু ভয় করছে না।” মনে মনে বলছে, “এই আমার অভিসার, বাইরে অন্ধকার ভিতরে আলো ৷” মেরে গিরিধর গোপাল, ঔর নাহি কেহি । SRG ইতিমধ্যে শ্যামাসুন্দরী হাঁপাতে হাঁপাতে মধুকে এসে জানালে, “বউ মুছে গেছে ।" মধুসূদনের মনটা দপ করে জ্বলে উঠল ; বললে, “কেন, তার হয়েছে কী ?” । “তা তো বলতে পারি নে, দাদা দাদা করেই বউ হেদিয়ে গেল । তা একবার কি দেখতে যাবে ?” “কী হবে ! আমি তো ওর দাদা নই।” “মিছে রাগ করছ ঠাকুরপো, ওরা বড়োঘরের মেয়ে, পোষ মানতে সময় লাগবে ।” “রোজ রোজ উনি মুছে যাবেন আর আমি ওঁর মাথায় কবিরাজি তেল মালিশ করব। এইজন্যেই কি ঔকে বিয়ে করেছিলুম ?” “ঠাকুরপো, তোমার কথা শুনে হাসি পায় । তা দোষ হয়েছে কী, আমাদের কালে কথায় কথায় মানিনীর মান ভাঙাতে হত, এখন না হয় মুছে ভাঙাতে হবে ।” মধুসূদন গো হয়ে বসে রইল। শ্যামাসুন্দরী বিগলিত করুণায় কাছে এসে হাত ধরে বললে,