পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVO রবীন্দ্র-রচনাবলী “ঠাকুরপো, অমন মন খারাপ কোরো না, দেখে সইতে পারি। নে ৷” মধুসূদনের এত কাছে গিয়ে ওকে সাস্তুনা দেয় ইতিপূর্বে এমন সাহস শ্যামার ছিল না। প্ৰগলভা। শ্যামা ওর কাছে ভারি চুপ করে থাকত ; জানত মধুসূদন বেশি কথা সইতে পারে না । মেয়েদের সহজ বুদ্ধি থেকে শ্যামা বুঝেছে মধুসূদন আজ সে-মধুসূদন নেই। আজ ও দুর্বল, নিজের মর্যাদা সম্বন্ধে সতর্কতা ওর নেই। মধুর হাতে হাত দিয়ে বুঝল এটা ওর খারাপ লাগে নি। নববধূ ওর অভিমানে যে ঘা দিয়েছে, কোনো-একটা জায়গা থেকে চিকিৎসা পেয়ে ভিতরে ভিতরে একটু আরাম বোধ হয়েছে। শ্যামা অন্তত ওকে অনাদর করে না, এটা তো নিতান্ত তুচ্ছ কথা নয়। শ্যামা কি কুমুর চেয়ে কম সুন্দরী, না হয় ওর রঙ একটু কালো— কিন্তু ওর চোখ, ওর চুল, ওর রসালো ঠোঁট ! শ্যামা বলে উঠল, “ঐ আসছে বউ, আমি যাই ভাই । কিন্তু দেখো ওর সঙ্গে রাগারগি কোরো না, আহা ও ছেলেমানুষ !” কুমু ঘরে ঢুকতেই মধুসূদন আর থাকতে পারলে না, বলে উঠল, “বাপের বাড়ি থেকে মুছে অভ্যোস করে এসেছ বুঝি ? কিন্তু আমাদের এখানে ওটা চলতি নেই। তোমাদের ঐ নুরনগরি চাল ছাড়তে হবে ।” কুমু নির্নিমেষ চােখ মেলে চুপ করে দাড়িয়ে রইল, একটি কথাও বললে না। মধুসূদন ওর মীেন দেখে আরো রেগে গেল। মনের গভীর তলায় এই মেয়েটির মন পাবার জন্যে একটা আকাঙক্ষা জেগেছে বলেই ওর এই তীব্র নিম্বফল রাগ | বলে উঠল, “আমি কাজের লোক, সময় কম, হিসটিরিয়া-ওয়ালী মেয়ের খেদমদগরি করবার ফুরসত আমার নেই, এই স্পষ্ট বলে দিচ্ছি।” কুমু ধীরে ধীরে বললে, “তুমি আমাকে অপমান কবতে চাও ? হার মানতে হবে । তোমার অপমান মনের মধ্যে নেব না ।” কুমু কাকে এ-সব কথা বলছে ? ওর বিস্ফারিত চােখের সামনে কে দাড়িয়ে আছে ? মধুসূদন অবাক হয়ে গেল, ভাবলে এ মেয়ে ঝগড়া করে না কেন ! এর ভাবখানা কী ? মধুসূদন বক্রোক্তি করে বললে, “তুমি তোমার দাদার চেলা, কিন্তু জেনে রেখো, আমি তোমার সেই দাদার মহাজন, তাকে এক হাটে কিনে আর-এক হাটে বেচিতে পারি।” ও যে কুমুর দাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ কথা কুমুর মনে দেগে দেবার জন্যে মূঢ় আর কোনো কথা খুঁজে (°न कीं । কুমু বললে, “দেখো, নিষ্ঠুর হও তো হােয়ো, কিন্তু ছােটাে হােয়ে না।” বলে সোফার উপর বসে পড়ল । কর্কশাস্বরে মধুসূদন বলে উঠল, “কী ! আমি ছােটাে !! আর তোমার দাদা আমার চেয়ে বড়ো ?” কুমু বললে, “তোমাকে বড়ো জেনেই তোমার ঘরে এসেছি।” মধুসূদন ব্যঙ্গ করে বললে, “বড়ো জেনেই এসেছ না, টাকার লোভে ?” তখন কুমু সোফা থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে খোলা ছাদে মেজের উপর গিয়ে বসল। কলকাতায় শীতকালের কৃপণ রাত্রি, ধোয়ায় কুয়াশায় ঘোলা, আকাশ অপ্ৰসন্ন, তারার আলো যেন ভাঙা গলার কথার মতো । কুমুর মন তখন অসাড়, কোনো ভাবনা নেই, কোনো বেদনা নেই। একটা ঘন কুয়াশার মধ্যে সে যেন লুপ্ত হয়ে গেছে। কুমু যে এমন করে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাবে মধুসূদন এ একেবারে ভাবতেই পারে নি। নিজের এই পরাভাবের জন্যে সকলের চেয়ে রাগ হচ্ছে কুমুর দাদার উপর। শোবার ঘরে চৌকির উপরে বসে পড়ে শূন্য আকাশের দিকে সে একটা ঘুষি নিক্ষেপ করলে। খানিকক্ষণ বসে থেকে ধৈর্য আর রাখতে পারলে না। ধড়ফড় করে উঠে ছাদে বেরিয়ে ওর পিছনে গিয়ে ডাকলে, “বড়োবউ !” কুমু চমকে উঠে পিছন ফিরে দাড়ালে। “ঠাণ্ডায় হিমে বাইরে এখানে দাড়িয়ে কী করছ ? চলো ঘরে ।” কুমু অসংকোচে মধুসূদনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মধুসূদনের মধ্যে যেটুকু প্ৰভুত্বের জোর ছিল