পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ Ves অভ্যাসমতই। মোটা চালের ভাত না হলে না মুখে রোচে, না পেট ভরে । কিন্তু পাত্রগুলি দামি । । রুপোর থালা, রুপোর বাটি, রুপোর গ্লাস। সাধারণত কলাইয়ের ডাল, মাছের ঝোল, তেঁতুলের অম্বল, কাটােচচ্চড়ি হচ্ছে খাদ্যসামগ্ৰী, তার পরে সব-শেষে বড়ো একবাটি দুধ চিনি দিয়ে শেষ বিন্দু পর্যন্ত সমাধা করে পানের বেঁটায় মোটা এক ফোটা চুন সহযোগে একটা পান মুখে ও দুটাে পান ডিবেয়া ভরে পনেরো মিনিট কাল তামাক টানতে টানতে বিশ্রাম করে তৎক্ষণাৎ আপিসে প্রস্থান। অপেক্ষাকৃত দৈন্যদশা থেকে আজ পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল এর আর ব্যতিক্রম হয় নি। আহারে মধুসূদনের ক্ষুধা আছে, লোভ নেই । শ্যামাসুন্দরী দুধের বাটিতে চিনি ঘেঁটে দিচ্ছিল। অনুজ্বল শ্যামবর্ণ, মোটা বললে যা বোঝায় তা নয়, কিন্তু পরিপুষ্ট শরীর নিজেকে বেশ একটু যেন ঘোষণা করছে। একখানি সাদা শাড়ির বেশি গায়ে কাপড় নেই, কিন্তু দেখে মনে হয়, সর্বদাই পরিচ্ছন্ন । বয়স যৌবনের প্রায় প্রান্তে এসেছে, কিন্তু যেন জ্যৈষ্ঠের অপরাহ্রের মতো, বেলা যায়-যায়। তবু গোধূলির ছায়া পড়ে নি। ঘন ভুরুর নীচে তীক্ষ কালো চােখ কাউকে যেন সামনে থেকে দেখে না, অল্প একটু দেখে সমস্তটা দেখে নেয়। তার টসটসে ঠোটদুটির মধ্যে একটা ভাব আছে যেন অনেক কথাই সে চেপে রেখেছে। সংসার তাকে বেশি কিছু রস দেয় নি, তবু সে ভরা। সে নিজেকে দামি বলেই জানে, সে কৃপণও নয়, কিন্তু তার মহাৰ্যতা ব্যবহারে লাগল না বলে নিজের আশপাশের উপর তার একটা অহংকৃত অশ্রদ্ধা । মধুসূদনের ঐশ্বর্যের জোয়ারের মুখেই শ্যামা এ সংসারে প্রবেশ করেছে। যৌবনের জাদুমন্ত্রে এই সংসারের চূড়ায় সে স্থান করে নেবে এমনও সংকল্প ছিল। মধুসূদনের মন যে কোনোদিন টলে নি তাও বলা যায় না। কিন্তু মধুসূদন কিছুতেই হার মানল না ; তার কারণ, মধুসূদনের বিষয়বুদ্ধি কেবলমাত্র যে বুদ্ধি তা নয়, সে হচ্ছে প্রতিভা। এই প্রতিভার জোরে সম্পদ সে সৃষ্টি করেছে, আর সেই সৃষ্টির পরমানন্দে গভীর করে সে মগ্ন । এই প্রতিভার জোরেই সে নিশ্চয় জানত ধন সৃষ্টির যে তপস্যায় সে নিযুক্ত ইন্দ্ৰদেব সেটা ভাঙবার জন্যে প্রবল বিদ্ম পাঠিয়েছেন— ক্ষণে ক্ষণে তপোভঙ্গের ধাক্কা লেগেছে, কার বারই সে সামলে নিয়েছে। সুবিধা ছিল এই যে, ব্যবসায়ের ভরা মধ্যাহ্নে তার অবকাশমাত্র ছিল না। এই কঠিন পরিশ্রমের মাঝখানে চোখের দেখায় কানের শোনায় শ্যামার যে সঙ্গটুকু নিঃসঙ্গভাবে পেত তাতে যেন মধুসূদনের ক্লান্তি দূর করত। ক্রিয়াকর্মের পার্বণী উপলক্ষে শ্যামাসুন্দরীর দিকে তার পক্ষপাতের ভারটা একটু যেন বেশি করে বুকত বলে বোঝা যায়। কিন্তু কোনোদিন শ্যামাকে সে এতটুকু প্রশ্ৰয় দেয় নি অন্তঃপুরে যাতে তার স্পর্ধা বাড়ে। শ্যামা মধুসূদনের মনের ঝোকটা ঠিক ধরেছে, তবুও ওর সম্বন্ধে তাঁর ভয় ঘুচল না। মধুসূদনের আহারের সময় শ্যামাসুন্দরী রোজই উপস্থিত থাকে ; আজও ছিল। সদ্য স্নান করে এসেছে- তার অসামান্য কালো ঘন লম্বা চুল পিঠের উপর মেলে দেওয়া- তার উপর দিয়ে অমলাশুভ্ৰ শাড়িটি মাথার উপর টেনে দেওয়া- ভিজে চুল থেকে মাথা ঘষা মসলার মৃদু গন্ধ আসছে। দুধের বাটি থেকে মুখ না তুলে এক সময় আস্তে আস্তে বললে, “ঠাকুরপো, বউকে কি ডেকে দেব ?” মধুসূদন কোনো কথা না বলে তার ভাজের মুখের দিকে গভীরভাবে চাইলে। তার ভাজ শ্যামাসুন্দরী ভয়ে থাতমত খেয়ে প্রশ্নটাকে ব্যাখ্যা করে বললে, “তোমার খাবার সময় কাছে বসলে হয় ভালো, তোমাকে একটু সেবা করতে-” মধুসূদনের মুখের ভাবের কোনো অর্থ বুঝতে না পেরে শ্যামাসুন্দরী বাক্য শেষ না করেই চুপ করে গেল। মধুসূদন আবার মাথা হেঁট করে আহারে লাগল। : 甲 কিছুক্ষণ পরে থালা থেকে মুখ না তুলেই জিজ্ঞাসা করলে, “বড়োবাউ এখন কোথায় ?” শ্যামাসুন্দরী ব্যস্ত হয়ে উঠল, “আমি দেখে আসছি।” । মধুসূদন ভুকুঞ্চিত করে আঙুল নেড়ে নিষেধ করলে। প্রশ্নের যে উত্তর পাবার আশা আছে সেটা এর মুখে শুনলে সহ্য হবে না- অথচ মনের মধ্যে যথেষ্ট কৌতুহল । আহার-শেষে তেতিলায় যখন