পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযােগ ৩৭৩ ৷৷ বললে, আজ রাত্রে সে খাবে না । মনকে বিশুদ্ধ করে নেবার জন্যেই তার এই উপবাস । মোতির মা কুমুর মুখ দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। সে মুখে আজ চিত্ত জ্বালার রক্তচ্ছটা ছিল না। ললাটে চক্ষুতে ছিল প্ৰশান্ত স্নিগ্ধ দীপ্তি। এখনই যেন সে পূজা সেরে তীর্থস্নান করে এল। অন্তর্যামী দেবতা যেন তার সব অভিমান হরণ করে নিলেন ; হৃদয়ের মাঝখানে যেন সে এনেছে নির্মাল্যের ফুল বহন করে, তারই সুগন্ধ রয়েছে তাকে ঘিরে। তাই কুমু যখন উপবাসী থাকতে চাইলে তখন মেতির মা বুঝলে, এ অভিমানের আত্মপীড়ন নয় । তাই সে আপত্তিমাত্র করলে না । কুমু তার ঠাকুরের মূর্তিকে অন্তরের মধ্যে বসিয়ে ছাদের এক কোণে গিয়ে আসন নিল। আজ সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে। দুঃখ যদি তাকে এমন করে ধাক্কা না দিত তা হলে সে আপন দেবতার এত কাছে কখনােই আসতে পারত না । অস্তসূর্যের আভার দিকে তাকিয়ে কুমুহাত জোড় করে বললে, “ঠাকুর, আর কখনো যেন তোমার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ না ঘটে ; তুমি আমাকে কঁদিয়ে তোমার আপন করে রাখো ।” শীতের দিন দেখতে দেখতে স্নান হয়ে এল। ধূলি কুয়াশা ও কলের ধোয়াতে মিশ্রিত একটা বিবর্ণ আবরণে সন্ধ্যার স্বচ্ছ তিমির-গভীর মহিমা আচ্ছন্ন । ঐ আকাশটা যেমন একটা পরিব্যাপ্ত মলিনতার বোঝা নিয়ে মাটির দিকে নেমে পড়েছে, তেমনি দাদার জন্যে একটা দুশ্চিন্তার দুঃসহ ভার কুমুর মনটাকে যেন নীচের দিকে নামিয়ে ধরে রেখে দিলে । এমনি করে এক দিকে কুমু অভিমানের বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে মুক্তির আনন্দ, আর-এক দিকে দাদার জন্যে ভাবনায় পীড়িত হৃদয়ের ভার, দুইই একসঙ্গে নিয়ে আবার তার সেই কোটরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল । বড়ো ইচ্ছা, এই নিরুপায় ভাবনার বোঝাটাকেও একান্ত বিশ্বাসে ভগবানের উপর সম্পূর্ণ সমৰ্পণ করে দেয়। কিন্তু নিজেকে বার বার ধিক্কার দিয়েও কিছুতেই সেই নির্ভর পায় না। : টেলিগ্রাফ তো করা হয়েছে, তার উত্তর আসে না কেন, এই প্রশ্ন অনবরত মনে লেগেই রইল। নারীহাদয়ের আত্মসমর্পণের সূক্ষ্ম বাধায় মধুসূদন কোথাও হাত লাগাতে পারছে না। যে বিবাহিত স্ত্রীর দেহমনের উপর তার সম্পূর্ণ দাবি সেও তার পক্ষে নিরতিশয় দুৰ্গম । ভাগ্যের এমন অভাবনীয় চক্রান্তকে সে কোন দিক থেকে কেমন করে আক্রমণ করবে ভেবে পায় না। কখনো কোনো কারণেই মধুসূদন নিজের ব্যাবসার প্রতি লেশমাত্র অমনােযোগী হয় নি, এখন সেই দুর্লক্ষণও দেখা দিল । নিজের মা'র পীড়া ও মৃত্যুতেও মধুসূদনের কর্মে কিছুমাত্র ব্যাঘাত ঘটে নি এ কথা সকলেই জানে। তখন তার অবিচলিত দৃঢ়চিত্ততায় অনেকে তাকে ভক্তি করেছে। মধুসূদন আজ হঠাৎ নিজের একটা নূতন পরিচয় পেয়ে নিজে স্তম্ভিত হয়ে গেছে, বাধা-পথের বাইরে যে শক্তি তাকে এমন করে টানছে সে যে তাকে কোন দিকে নিয়ে যাবে ভেবে পাচ্ছে না। রাত্রের আহার সেরে মধুসূদন ঘরে শুতে এল। যদিও বিশ্বাস করে নি, তবু আশা করেছিল। আজ হয়তো কুমুকে শোবার ঘরে দেখতে পাবে। সেইজন্যেই নিয়মিত সময় অতিক্রম করেই মধুসূদন এল। সুস্থ শরীরে চিরাভ্যাসমত একেবারে ঘড়িধারা সময়ে মধুসূদন ঘুমিয়ে পড়ে, এক মুহুর্ত দেরি হয় না । পাছে আজ তেমনি ঘুমিয়ে পড়ার পর কুমু ঘরে আসে তার পরে চলে যায়, এই ভয়ে বিছানায় শুতে গেল না। সোফায় খানিকটা বসে রইল, ছাদে খানিকটা পায়চারি করতে লাগল। মধুসূদনের ঘুমোবার সময় নটা- আজ একসময়ে চমকে উঠে শুনলে তার দেউড়ির ঘণ্টায় এগারোটা বাজছে । লাজা বোধ হল। কিন্তু বিছানার সামনে দু-তিনবার এসে চুপ করে দাড়িয়ে থাকে, কিছুতে শুতে যেতে প্ৰবৃত্তি হয় না। তখন স্থির করলে বাইরের ঘরে গিয়ে সেই রাত্রেই নবীনের সঙ্গে কিছু বোঝাপড়া করে নেবে। বাইরের ঘরের সামনের বারান্দায় পৌছিয়ে দেখে ঘরে তখনো আলো জ্বলছে। সেও ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে এমন সময়ে দেখে নবীন লণ্ঠন হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। দিনের বেলা হলে দেখতে পেত এক মুহুর্তে নবীনের মুখ কী রকম ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মধুসূদন জিজ্ঞাসা করলে, “এত রাত্ৰে তুমি যে এখানে ?” নবীনের মাথায় বুদ্ধি জোগােল, সে বললে, “শুতে যাবার আগেই তো আমি ঘড়িতে দম দিয়ে যাই,