পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ v9ዓ ዓ বিতৃষ্ণাবােধকে তাড়িয়ে রাখতে হবে। এই অবস্থায় মেয়েরা যদি কোনােমতে একজন গুরুকে পায় 蹟 তবে তার আত্মবিস্মৃতির চিকিৎসা সহজ হয় ; সে তো সম্ভব হল না। তাই মনে মনে পূজার মন্ত্রকে নিয়তই বাজিয়ে রাখতে চেষ্টা করলে । তার এই দিনরাত্রির মন্ত্রটি ছিল— তস্মাৎ প্ৰণম্য প্ৰণিধায় কায়ং প্ৰসাদয়ে ত্বম অহমীশমীড্যং পিতেপ পুত্ৰস্য সখেব সখ্যুঃ প্রিয়ঃ প্রিয়ায়াহঁসি দেব সোঢ়ম | হে আমার পূজনীয়, তোমার কাছে আমার সমস্ত শরীর প্রণত করে এই প্রসাদটি চাই যে, পিতা যেমন করে পুত্ৰকে, সখা যেমন করে সখাকে, প্রিয় যেমন করে প্রিয়াকে সহ্য করতে পারেন, হে দেব, তুমিও যেন আমাকে তেমনি করে সইতে পাের। তুমি যে তোমার ভালোবাসায় আমাকে সহ্য করতে পার তার প্রমাণ এ ছাড়া আর কিছু নয় যে, তোমার ভালোবাসায় আমিও সমস্ত ক্ষমা করতে পারি। কুমু চােখ বুজে মনে মনে তঁকে ডেকে বলে, “তুমি তো বলেছ, যে মানুষ আমাকে সব জায়গায় দেখে, আমার মধ্যে সমস্তকে দেখে, সেও আমাকে ত্যাগ করে না, আমিও তাকে ত্যাগ করি নে। এই সাধনায় আমার যেন একটুও শৈথিল্য না হয়।” আজ সকালে স্নান করে চন্দন-গােলা জল দিয়ে তার শরীরকে অনেকক্ষণ ধরে অভিষিক্ত করে নিলে । দেহকে নির্মল করে সুগন্ধি করে সে তাকে উৎসর্গ করে দিলে— মনে মনে একাগ্রতার সঙ্গে ধ্যান করতে লাগল যে, নিমেষে নিমেষে তার হাতে র্তার হাত আছে, তার সমস্ত শরীরে তার সর্বব্যাপী স্পর্শ অবিরাম বিরাজমান। এ দেহকে সত্যরূপে সম্পূর্ণরূপে তিনিই পেয়েছেন, তীর পাওয়ার বাইরে যে শরীরটা সে তো মিথ্যা, সে তো মায়া, সে তো মাটি, দেখতে দেখতে মাটিতে মিশিয়ে যাবে। যতক্ষণ র্তার স্পর্শকে অনুভব করি ততক্ষণ এ দেহ কিছুতেই অপবিত্র হতে পারে না। এই কথা মনে করতে করতে আনন্দে তার চােখের পাতা ভিজে এল— তার দেহটা যেন মুক্তি পেলে মাংসের স্কুল বন্ধন থেকে । পুণ্যসম্মিলনের নিত্যক্ষেত্র বলে আপন দেহের উপর তার যেন ভক্তি এল। যদি কুন্দযুকূলের মালা হাতের কাছে পেত তা হলে এখনই আজ সে পরত। গলায়, বাধত কবরীতে। স্নান করে পরল। সে একটি শুভ্ৰ শাড়ি, খুব মোটা লাল পাড় দেওয়া । ছাদে যখন বসল। তখন মনে হল সূর্যের আলো হয়ে আকাশপূর্ণ একটি পরম স্পর্শ তার দেহকে অভিনন্দিত করলে। মোতির মা'র কাছে এসে কুমু বললে, “আমাকে তোমার কাজে লাগিয়ে দাও।” মোতির মা হেসে বললে, “এসো। তবে তরকারি কুটিবে।” মন্ত মস্ত বারকোশ, বড়ো বড়ো পিতলের খোরা, বুড়ি বুড়ি শাকসবজি, দশ-পনেরোটা বঁটি পাতা— আত্মীয়া-আশ্ৰিতারা গল্প করতে করতে দ্রুত হাত চালিয়ে যাচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত খণ্ডবিখণ্ডিত তরকারিগুলো স্তৃপাকার হয়ে উঠছে। তারই মধ্যে কুমু এক জায়গায় বসে গেল। সামনে গরাদের ভিতর দিয়ে দেখা যায় পাশের বসতির এক বৃদ্ধ তেঁতুল গাছ তার চিরাচঞ্চল পাতাগুলো দিয়ে সূর্যের আলো চূৰ্ণ চুৰ্ণ করে ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে। মোতির মা মাঝে মাঝে কুমুর মুখের দিকে চেয়ে দেখে আর ভাবে, ও কি কাজ করছে, না, ওর আঙুলের গতি আশ্রয় করে ওর মন চলে যাচ্ছে কোন এক তীর্থের পথে ? ওকে দেখে মনে হয় যেন পালের নীেকো, আকাশে-তোলা পালটাতে হাওয়া এসে লাগছে, নীেকোটা যেন সেই সম্পর্শেই ভোর, আর তার খোলের দুধারে যে জল কেটে কেটে পড়ছে সেটা যেন খেয়ালের মধ্যেই নেই। ঘরে অন্য যারা কাজ করছে তারা যে কুমুর সঙ্গে গল্পগুজব করবে। এমন যেন একটা সহজ। রাস্তা পাচ্ছে না। শ্যামাসুন্দরী একবার বললে, “বউ, সকালেই যদি স্নান কর, গরম জল বলে দাও না কেন ? ঠাণ্ডা লাগবে না তো ?” কুমু বললে, “আমার অভ্যোস আছে।”