পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vr V রবীন্দ্র-রচনাবলী ভাঙলি না । তাকে ঠেলা দিতেই ধড়ফড় করে জেগে সে উঠে বসল। মধুসূদন তার কোনোরকম কৈফিয়ত তলব না করেই বললে, “এখনই যা, বড়োবউকে বল গে। আমি তাকে শোবার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছি।” বলে তখনই সে অন্তঃপুরে চলে গেল । কিছুক্ষণ পরেই কুমু শোবার ঘরে এসে প্রবেশ করলে। মধুসূদন তার মুখের দিকে চাইলে । সাদাসিধে একখানি লালপোড়ে শাড়ি পরা । শাড়ির প্রান্তটি মাথার উপর টানা । এই নির্জন ঘরের অল্প আলোয় এ কী অপরূপ আবির্ভাব ! কুমু ঘরের প্রান্তের সোফাটির উপরে বসল। মধুসূদন তখনই এসে বসল মেজের উপরে তার পায়ের কাছে। কুমু সংকুচিত হয়ে তাড়াতাড়ি ওঠবার চেষ্টা করবামাত্র মধুসূদন হাতে ধরে তাকে টেনে বসালে ; বললে, “উঠে না, শোনো আমার কথা । আমাকে মাপ করো, আমি দোষ করেছি।” মধুসূদনের এই অপ্রত্যাশিত বিনতি দেখে কুমু অবাক হয়ে রইল। মধুসূদন আবার বললে, “নবীনকে মেজেবিউকে রাজবপুরে যেতে আমি বারণ করে দেব । তারা তোমার সেবাতেই থাকবে ।” কুমু কী যে বলবে কিছুই ভেবে পেলে না। মধুসূদন ভাবলে, নিজের মান খর্ব করে আমি বড়োবউয়ের মান ভািঙব । হাত ধরে মিনতি করে বললে, “আমি এখনই আসছি। বলো তুমি চলে यात नीं ।” কুমু বললে, “না, যাব না।” মধুসূদন নীচে চলে গেল। মধুসূদন যখন ক্ষুদ্র হয়, কঠোর হয়, তখন সেটা কুমুদিনীর পক্ষে তেমন কঠিন নয় । কিন্তু আজ তার এই নম্রতা, এই তার নিজেকে খর্ব করা, এর সম্বন্ধে কুমুর যে কী উত্তর তা সে ভেবে পায় না । হৃদয়ের যে দান নিয়ে সে এসেছিল সে তো সব স্থলিত হয়ে পড়ে গেছে, আর তো তা ধুলো থেকে কুড়িয়ে নিয়ে কাজ চলবে না । আবার সে ঠাকুরকে ডাকতে লাগল, “প্রিয়ঃ প্রিয়ায়াহঁসি দেব সোঢ়ম।” খানিক বাদে মধুসূদন নবীন ও মেতির মাকে সঙ্গে নিয়ে কুমুর সামনে উপস্থিত করলে । তাদের সম্বোধন করে বললে, “কাল তোমাদের রজবপুরে যেতে বলেছিলাম, কিন্তু তার দরকার নেই। কাল থেকে বড়োবিউয়ের সেবায় আমি তোমাদের নিযুক্ত করে দিচ্ছি।” শুনে ওরা দুজনে অবাক হয়ে গেল। একে তো এমন হুকুম প্রত্যাশা করে নি, তার পরে এত রাত্তিরে ওদের ডেকে এনে এ কথা বলবার জরুরি দরকার কী ছিল । মধুসূদনের ধৈর্য সবুর মানছিল না। আজ রাত্তিরেই কুমুর মনকে ফেরাবার জন্যে উপায় প্রয়োগ করতে কার্পণ্য বা সংকোচ করতে পারলে না। এমন করে নিজের মর্যাদা ক্ষুন্ন সে জীবনে কখনো করে নি। সে যা চেয়েছিল তা পাবার জন্যে তার পক্ষে সব চেয়ে দুঃসাধ্য মূল্য সে দিলে। তার ভাষায় সে কুমুকে বুঝিয়ে দিলে, তোমার কাছে আমি অসংকোচে হার মানছি। এইবার কুমুর মনে বড়ো একটা সংকোচ এল, সে ভাবতে লাগল। এই জিনিসটাকে কেমন করে সে গ্রহণ করবে ? এর বদলে কী আছে তার দেবার ? বাইরে থেকে জীবনে যখন বাধা আসে তখন লড়াই করবার জোর পাওয়া যায়, তখন স্বয়ং দেবতাই হন সহায় । হঠাৎ সেই বাইরের বিরুদ্ধতা একেবারে নিরন্ত হলে যুদ্ধ থামে। কিন্তু সন্ধি হতে চায় না। তখন বেরিয়ে পড়ে নিজের ভিতরের প্রতিকূলতা। কুমু হঠাৎ দেখতে পেলে মধুসূদন যখন উদ্ধত ছিল তখন তার সঙ্গে ব্যবহার অপ্রিয় হােক তবুও তা সহজ ছিল ; কিন্তু মধুসূদন যখন নম্র হয়েছে তখন তার সঙ্গে ব্যবহার কুমুর পক্ষে বড়ো শক্ত হয়ে উঠল। এখন তার ক্ষুব্ধ অভিমানের আড়াল থাকে না, তার সেই ফরাশখানার আশ্রয় চলে যায়, এখন দেবতার কাছে হাত জোড় করবার কোনো মানে নেই। মােতির মাকে কোনাে ছুতোয় কুমুযদি রাখতে পারত তা হলে সে বেঁচে যেত। কিন্তু নবীন গোল চলে, হতবুদ্ধি মােতির মাও আস্তে আস্তে চলল তার পিছনে। দরজার কাছে এসে একবার মুখ আড় করে উদবিগ্নভাবে কুমুদিনীর মুখের দিকে চেয়ে গেল। স্বামীর প্রসন্নতার হাত থেকে এই মেয়েটিকে এখন কে বাচাবে ? :