পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V&O রবীন্দ্র-রচনাবলী মধুসূদন দৃঢ়স্বরে পুনরায় বললে, “যাও, আর দেরি কোরো না |” কুমু বিছানায় যখন প্রবেশ করলে মধুসূদন সােফার উপরে বসে বললে, “এইখানেই বসে রইলুম, যদি আমাকে ডাক তবেই যাব। বৎসরের পর বৎসর অপেক্ষা করতে রাজি আছি।” কুমুর সমস্ত গা এল ঝিম্ ঝিম করে- এ কী পরীক্ষা তার ! কার দরজায় সে আজ মাথা কুটবে ? দেবতা তো তাকে সাড়া দিলেন না। যে পথ দিয়ে সে এখানে এল সে তো একেবারেই ভুল পথ । বিছানায় বসে বসে মনে মনে সে বললে, “ঠাকুর, তুমি আমাকে কখনো ভোলাতে পার না, এখনো তোমাকে বিশ্বাস করব। ধ্রুবকে তুমিই বনে এনেছিলে, বনের মধ্যে তাকে দেখা দেবে বলে।’ সেই নিস্তব্ধ ঘরে আর শব্দ নেই ; রাস্তার মোড়ে সেই মাতালটার গলা শোনা যায় না ; কেবল সেই বন্দী কুকুরটা যদিও শ্রান্ত তবু মাঝে মাঝে আর্তনাদ করে উঠছে। অল্প সময়কেও অনেক সময় বলে মনে হল, স্তব্ধতার ভারগ্রস্ত প্রহর যেন নড়তে পারছে না । এই কি তার দাম্পত্যের অনন্তকালের ছবি ? দুপারে দুজনে নীরবে বসে— রাত্রির শেষ নেই- মাঝখানে একটা অলঙ্ঘনীয় নিস্তব্ধতা ! অবশেষে এক সময় কুমু তার সমস্ত শক্তিকে সংহত করে নিয়ে বিছানা থেকে বেরিয়ে এসে বললে, “আমাকে অপরাধিনী কোরো না ।” মধুসূদন গভীরকণ্ঠে বললে, “কী চাও বলো, কী করতে হবে ?” শেষ কথাটুকু পর্যন্ত একেবারে নিংড়ে বের করে নিতে চায় । কুমু বললে, “শুতে এসো।” কিন্তু একেই কি বলে জিত ? \by পরের দিন সকালে মোতির মা যখন কুমুর জন্যে এক বাটি দুধ নিয়ে এল, দেখলে কুমুর দুই চোখ লাল, ফুলে আছে, মুখের রঙ হয়েছে পাশের মতো । সকালে ছাদের যে কোণে আসন পেতে পূব দিকে মুখ করে সে মানসিক পূজায় বসে, ভেবেছিল সেইখানে কুমুকে দেখতে পাবে। কিন্তু আজ সেখানে নেই, সিঁড়ি দিয়ে উঠেই যে একটুখানি ঢাকা ছাদ, সেইখানেই দেয়ালের গায়ে অবসন্নভাবে ঠেসান দিয়ে সে মাটিতে বসে। আজ বুঝি ঠাকুরের উপরে রাগ করেছে। নিরপরাধ ছেলেকে নিষ্ঠুর বাপ যখন অকারণ মারে তখন সে যেমন কিছুই বুঝতে পারে না, অভিমান করে আঘাত গায়ে পেতে নেয়, প্রতিবাদ করবারও চেষ্টা করতে মুখে বাধে, ঠাকুরের পরে কুমুর আজ সেইরকম ভাব । যে আহবানকে সে দৈব বলে মেনেছিল, সে কি এই অশুচিতার মধ্যে, এই আন্তরিক অসতীত্বে ? ঠাকুর নারীবলি চান বলেই শিকার ভুলিয়ে এনেছেন নাকি ; যে শরীরটার মধ্যে মন নেই সেই মাংসপিণ্ডকে করবেন তার নৈবেদ্য ? আজ কিছুতে ভক্তি জাগল না। এতদিন কুমুবার বার করে বলেছে, আমাকে তুমি সহ্য করো— আজ বিদ্রোহিণীর মন বলছে, তোমাকে আমি সহ্য করব কী করে ? কোন লজ্জায় আনব তোমার পূজা ? তোমার ভক্তকে নিজে না গ্রহণ করে তাকে বিক্রি করে দিলে কোন দাসীর হাটে- যে হাটে মাছমাংসের দরে মেয়ে বিক্রি হয়, যেখানে নির্মাল্য নেবার জন্যে কেউ শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজার অপেক্ষা করে না, ছাগলকে দিয়ে ফুলের বন মুড়িয়ে খাইয়ে দেয় । মোতির মা যখন দুধ খাবার জন্যে অনুরোধ করলে, কুমু বললে, “থাক।” মোতির মা বললে, “কেন, থাকবে কেন ? আমার দুধের বাটির অপরাধ কী ?” কুমু বললে, “এখনো স্নান করি নি, পূজা করি নি।” মোতির মা বললে, “যাও তুমি স্নান করতে, আমি অপেক্ষা করে থাকব ।” কুমু স্নান সেরে এল। মোতির মা ভাবলে এইবার সে খোলা ছাদের কোণটাতে গিয়ে বসবে। কুমু মুহুর্তের জন্যে অভ্যাসের টানে ছাদের দিকে যেতে পা বাড়িয়েছিল, গেল না, ফিরে আবার সেই মাটিতে এসে বসল। তার মন তৈরি ছিল না । মোতির মাকে কুমু জিজ্ঞাসা করলে, “দাদার চিঠি কি আসে নি ?” ।