পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ৩৯১ চিঠি খুব সম্ভব এসেছে মনে করেই আজ খুব ভোরে মোতির মা নিজে লুকিয়ে আপিসঘরে গিয়ে চিঠির দেরাজটা টানতে গিয়ে দেখলে সেটা চাবি দিয়ে বন্ধ। অতএব এখন থেকে চুরির উপর বাটপাড়ি করবার রাস্তা আটক রইল । তির মা বললে, “ঠিক বলতে তো পারি নে, খবর নিয়ে দেখব ।” এমন সময় হঠাৎ শ্যামা এসে উপস্থিত ; বললে, “বউ, তোমাকে এমন শুকনো দেখি যে, অসুখ করে নি তো ?” কুমু বললে, “না।” “বাড়ির জন্যে মনটা কেমন করছে। আহা, তা তো হতেই পারে। তা তোমার দাদা তো আসছেন, দেখা হবে ।” কুমু চমকে উঠে শ্যামার মুখের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চাইলে । মোতির মা জিজ্ঞাসা করলে, “এ খবর তুমি কোথায় পেলে বকুলফুল ?” “ঐ শোনো ! এ তো সবাই জানে। আমাদের রান্নাঘরের পার্বতী যে বললে, ওঁর বাপের বাড়ির সরকার এসেছিল রাজাবাহাদুরের কাছে, বউয়ের খবর নিতে । তার কাছে শুনেছে, চিকিৎসার জন্যে বউয়ের দাদা আজকালের মধ্যেই কলকাতায় আসছেন ।” কুমু উদবিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “র্তার ব্যামো কি বেড়েছে ?” “তা বলতে পারি নে। তবে এমন কিছু ভাবনার কথা নেই, তা হলে শুনতুম ||” শ্যামা বুঝেছিল ওর দাদার খবর মধুসূদন কুমুকে দেয় নি, যে বউয়ের মন পায় নি, পাছে সে বাড়িমুখো হয়ে আরো অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কুমুর মনটাকে উসকিয়ে দিয়ে বললে, “তোমার দাদার মতো মানুষ হয় না। এই কথা সবার কাছেই শুনি । বকুলফুল, চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে, ভাড়ার দিতে হবে । আপিসের রান্না চড়াতে দেরি হলে মুশকিল যাধবে ।” মোতির মা দুধের বাটিটা আর-একবার কুমুর কাছে এগিয়ে নিয়ে বললে, “দিদি, দুধ ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে ফেলো লক্ষ্মৗটি ।” এবার কুমু দুধ খেতে আপত্তি করলে না । মোতির মা কানে কানে জিজ্ঞাসা করলে, “ভাড়ারঘরে যাবে আজ ?” কুমু বললে, “আজ থােক- গোপালকে আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দাও।” একটা কালো কঠোর ক্ষুধিত জরা বাহির থেকে কুমুকে গ্ৰাস করছে রাহুর মতো। যে পরিণত বয়স শান্ত স্নিগ্ধ শুভ্ৰ সুগভীর, এ তো তা নয় ; যা লালায়িত, যার সংযমের শক্তি শিথিল, যার প্ৰেম বিষয়াসক্তিরই স্বজাতীয়, তারই স্বেদাক্ত স্পর্শে কুমুর এত বিতৃষ্ণা। ওর স্বামীর বয়স বেশি বলে কুমুর কোনো আক্ষেপ ছিল না, কিন্তু সেই বয়স নিজের মর্যাদা ভুলেছে বলে তার এত পীড়া । সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন একটা ফলের মতো, আলো-হাওয়ায় মুক্তির মধ্যে সে পাকে, কঁচা ফলকে জাতীয় পিষলেই তো পাকে না । সময় পেল না বলেই আজ ওদের সম্বন্ধ কুমুকে এমন করে মারছে, এত অপমান করছে। কোথায় পালাবে ! মোতির মাকে ঐ যে বললে, গোপালকে ডেকে দাও, সে এই পালাবার পথ খোজা- বৃদ্ধ অশুচিতার কাছ থেকে নবীন নির্মলতার মধ্যে, দূষিত নিশ্বাসবাষ্প থেকে ফুলের বাগানের হাওয়ায় । একটা পাতলা তুলে-ভরা ছিটের জামা গায়ে দিয়ে হাবলু সিঁড়ির দরজার কাছে এসে ভয়ে ভয়ে দাঁড়াল । ওর মায়ের মতোই বড়ো বড়ো কালো চোখ, তেমনিই জলভরা মেঘের মতো সরস শামলা রঙ, গাল দুটাে ফুলো ফুলো, প্রায় ন্যাড়া করে চুল ছাটা । r কুমু উঠে গিয়ে সংকুচিত হাবলুকে টেনে এনে বুকে চেপে ধরলে ; বললে, “দুন্টু ছেলে, এ দুদিন আস নি কেন ?” ... ' ー上 মৃত্যু কৃষ্ণ গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললে, “জ্যাঠাইল, তােমার জনে কী এনেছি বলে "