পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ©እዒ তক্তপোশের উপর কুমু বসল। নবীন বললে, “বড়ো অত্যাচার ! এই ভদ্রমহিলা আমার বই রেখেছেন লুকিয়ে।” “এমন শাসন কেন ।” “ঈর্ষা- যেহেতু নিজে ইংরেজি পড়তে পারেন না । আমি স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে, কিন্তু উনি স্বামী-জাতির এডুকেশনের বিরোধী। আমার বুদ্ধির যতই উন্নতি হচ্ছে, ওঁর বুদ্ধির সঙ্গে ততই গরমিল হওয়াতে ওঁর আক্ৰোশ । অনেক করে বোঝালেম যে, এতবড়ো যে সীতা তিনিও রামচন্দ্রের পিছনে মুকুতন বলেছিতে আমি যে তােমাৰ চায় অনেকদূর এগিয়ে এগিয়ে সন্ধি এতে বাধা দিয়ে না ।” r “তোমার বিদ্যের কথা মা সরস্বতী জানেন, কিন্তু বুদ্ধির বড়াই করতে এসো না বলছি।” নবীনের মহা বিপদের ভান করা মুখভঙ্গি দেখে কুমুখিলখিল করে হেসে উঠল। এ বাড়িতে এসে অবধি এমন মন খুলে হাসি এই ওর প্রথম । এই হাসি নবীনের বড়ো মিষ্টি লাগল। সে মনে মনে বললে, “এই আমার কাজ হল, আমি বউরানীকে হাসাব ।” “দেখো তো দিদি, শোবার ঘরে কি ওঁর পাঠশালার গুরুমশায় বসে আছেন ? খেটে খুটে রাত্তিরে - ঘরে এসে দেখি একটা পিদিম জ্বলছে, তার সঙ্গে আর-একটা বাতির শেজ, মহাপণ্ডিত পড়তে বসে গেছেন। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তাগিদের পর তাগিদ, ইহঁশ নেই।” “সত্যি ঠাকুরপো ?” U “বউরানী, খাবার ভালোবাসি নে এতবড়ো তপস্বী নই, কিন্তু তার চেয়ে ভালোবাসি ঔর মুখের মিষ্টি তাগিদ । সেইজন্যেই ইচ্ছে করে খেতে দেরি হয়ে যায়, বই পড়াটা একটা আছিলে ।” “ওঁর সঙ্গে কথায় হার মানি ।” । “আর আমি হার মানি যখন উনি কথা বন্ধ করেন ।” “তাও কখনো ঘটে নাকি ঠাকুরপো ?” “দুটাে একটা খুব তাজা দৃষ্টান্ত দিই তা হলে। অশ্রুজিলের উজ্জ্বল অক্ষরে মনে লেখা রয়েছে।” “আচ্ছ। আচ্ছা, তোমার আর দৃষ্টান্ত দিতে হবে না। এখন আমার চাবি কোথায় বলে। দেখো তো হয় । আগে দাও আমার বই ।” “তোমাকে দেব না, দিদিকে দিচ্ছি।” ঘরের কোণে একটা বুড়িতে রেশম-পশম, টুকরা কাপড়, ছেড়া মোজা জমে ছিল ; তারই তলা থেকে একখানা ইংরেজি সংক্ষিপ্ত এনসাইক্লোপীডিয়ার দ্বিতীয় খণ্ড বের করে মেতির মা কুমুর কোলের উপর রেখে বললে, “তোমার ঘরে নিয়ে যাও দিদি, ওঁকে দিয়ে না ; দেখি তোমার সঙ্গে কী রকম রাগারগি করেন।” নবীন মশারির চালের উপর থেকে চাবি তুলে নিয়ে কুমুর হাতে দিয়ে বললে, “আর কাউকে দিয়ো না বউদিদি, দেখব। আর কেউ তোমার সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করেন ।” কুমু বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললে, “এই বইয়ে বুঝি ঠাকুরপোর শখ ?” “ওঁর শখ নেই এমন বই নেই। সেদিন দেখি কোথা থেকে একখানা গো-পালন জুটিয়ে নিয়ে পড়তে বসে গেছেন ।” “নিজের দেহরক্ষার জন্যে ওটা পড়ি নে, অতএব এতে লজ্জার কারণ কিছু নেই।” মািৰ, তােমার কী একটা কথা বলবার আছে। চাও তো, এই বাচালটিকে এখনই বিদায় করে । - "ן “না, তার দরকার নেই। আমার দাদা দুই-একদিনের মধ্যে আসবেন শুনেছি।” নবীন বললে, “হা, তিনি কালই আসবেন ।”