পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 8 Os মানুষকে বিশ্বাস করলে মানুষ বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। গ্রহদেরও ঠিক সেই দশা, দেখে-না কেন সাহেবগুলো গ্ৰহ মানে না বলে গ্রহের ফল ওদের উপর খাটে না । সেদিন তেরোস্পর্শে বেরিয়ে তোমাদের ছোটােসাহেব ঘোড়দৌড়ে বাজি জিতে এল- আমি হলে বাজি জেতা দূরস্তাং ঘোড়াটা ছিটকে এসে আমার পেটে লাথি মেরে যেত । দাদা, এই-সব গ্রহনক্ষত্রের হিসেবের উপর তোমাদের বুদ্ধি খাটাতে যেয়ে না, একটু বিশ্বাস মনে রেখো ।” মধুসূদন খুশি হয়ে স্মিতহাস্যে গুড়গুড়িতে মনোযোগ দিলে। KWA পরদিন সকাল সাতটার মধ্যে মধুসূদন নবীনের সঙ্গে এক সরু গলির আবর্জনার ভিতর দিয়ে বেঙ্কট শাস্ত্রীর বাসায় গিয়ে উপস্থিত। অন্ধকার একতলার ভাপসা ঘর ; লোনাধরা দেয়াল ক্ষতবিক্ষত, যেন সাংঘাতিক চর্মরোগে আক্রান্ত, তক্তপোশের উপর ছিন্ন মলিন একখানা শতরঞ্চি, এক প্ৰান্তে কতকগুলো পুঁথি এলোমেলো জড়োকরা, দেয়ালের গায়ে শিবপার্বতীর এক পট । নবীন হাক দিলে, “শাস্ত্রীজি ।” ময়লা ছিটের বাল্যাপোেশ গায়ে, সামনের মাথা কামানো, কুঁটিওয়ালা, কালো বেঁটে রোগা এক ব্যক্তি ঘরে এসে ঢুকলা ; নবীন তাকে ঘটা করে প্রণাম করলে । চেহারা দেখে মধুসূদনের একটুও ভক্তি হয় নি- কিন্তু দৈবের সঙ্গে দৈবজ্ঞের কোনোরকম ঘনিষ্ঠতা আছে জেনে ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি একটা আধাআধি রকম অভিবাদন সেরে নিলে। নবীন মধুসূদনের একটি ঠিকুজি জ্যোতিষীর সামনে ধরতেই সেটা অগ্রাহ্য করে শাস্ত্রী মধুসূদনের হাত দেখতে চাইলে । কাঠের বাক্স থেকে কাগজ-কলম বের করে নিয়ে নিজে একটা চক্র তৈরি করে নিলে। মধুসূদনের মুখের দিকে চেয়ে বললে, “পঞ্চম বর্গ।” মধুসূদন কিছুই বুঝলে না। জ্যোতিষী আঙুলের পর্ব গুনতে গুনতে আউড়ে গেল, কবর্গ চবৰ্গ, টবর্গ, তবর্গ, পবর্গ। এতেও মধুসূদনের বুদ্ধি খোলসা হল না। জ্যোতিষী বললে, “পঞ্চম বর্ণ।” মধুসূদন ধৈর্য ধরে চুপ করে রইল। জ্যোতিষী, আওড়াল, প, ফ, ব, ভ, মী। মধুসূদন এর থেকে এইটুকু বুঝলে যে, ভৃগুমুনি ব্যাকরণের প্রথম অধ্যায় থেকেই তার সংহিতা শুরু করেছেন । এমন সময় বেঙ্কট শাস্ত্রী বলে উঠল, “পঞ্চাক্ষরকং ।” r নবীন চকিত হয়ে মধুসূদনের কাছে চুপি চুপি বললে, “বুঝেছি দাদা।” “কী বুঝলে ?” “পঞ্চম বর্গের পঞ্চম বর্ণম, তার পরে পঞ্চ অক্ষর ম-ধু-সূদ-ন। জন্ম-গ্রহের অদ্ভুত কৃপায় তিনটে পাচ এক জায়গায় মিলেছে।” মধুসূদন স্তম্ভিত । বাপ মায়ে নাম রাখবার কত হাজার বছর আগেই নামকরণ ভৃগুমুনির খাতায় ! নক্ষত্রদের এ কী কাণ্ড ! তার পরে হতবুদ্ধি হয়ে শুনে গেল ওর জীবনের সংক্ষিপ্ত অতীত ইতিহাস সংস্কৃত ভাষায় রচিত। ভাষা যত কম বুঝলে, ভক্তি ততই বেড়ে উঠল। জীবনটা আগাগোড়া ঋষিবাক্য মূর্তিমান । নিজের বুকের উপর হাত বুলিয়ে দেখলে, দেহটা অনুস্বার-বিসর্গ-তদ্ধিত-প্রত্যয়ের মসলা দিয়ে তৈরি কোন তপোবনে লেখা একটা পুঁথির মতো । তার পর দৈবজ্ঞের শেষ কথাটা এই যে, মধুসূদনের ঘরে একদা লক্ষ্মীর আবির্ভাব হবে বলে পূর্ব হতেই ঘরে অভাবনীয় সৌভাগ্যের সূচনা। অল্পদিন হল তিনি এসেছেন নববধূকে আশ্রয় করে। এখন থেকে সাবধান। কেননা ইনি যদি মনঃপীড়া পান, ভাগ্য কুপিত হবে । বেঙ্কট শাস্ত্রী বললে, কোপের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। জাতিক যদি এখনো সতর্ক না হয় বিপদ বেড়ে চলবে । মধুসূদন স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল । মনে পড়ে গেল বিবাহের দিনই প্রকাণ্ড সেই মুনফার খবর ; আর তার কয়দিনের মধ্যেই এই পরাভব । লক্ষ্মী স্বয়ং আসেন সেটা সৌভাগ্য, কিন্তু তার দায়িত্বটা কম ভয়ংকর নয় । ফেরবার সময় মধুসূদন গাড়িতে স্তব্ধ হয়েই বসে রইল। এক সময় নবীন বলে উঠল, “ঐ বেঙ্কট শাস্ত্রীর কথা একটুও বিশ্বাস করি নে ; নিশ্চয় ও কারও কাছ থেকে তোমার সমস্ত খবর পেয়েছে।” লুড়ি তােমার। যেখানে যত মানুহ আছে আগেভাগে তার খবর নিয়ে রেখে দিচ্ছে, সােঙ্গা কথা "