পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 OR রবীন্দ্র-রচনাবলী “মানুষ জন্মাবার আগেই তার কোটি কোটি কুষ্ঠি লেখার চেয়ে এটা অনেক সোজা ! ভৃগুমুনি এত কাগজ পাবেন কোথায়, আর বেঙ্কট স্বামীর ঐ ঘরে এত জায়গা হবে কেমন করে ?” “এক আঁচড়ে হাজারটা কথা লিখতে জানতেন তঁরা ।” “অসম্ভব ।” “যা তোমার বুদ্ধিতে কুলোয় না। তাই অসম্ভব। ভারি তোমার সায়ান্স ! এখন তর্ক রেখে দাও, সেদিন ওদের বাড়ি থেকে যে সরকার এসেছিল, তাকে তুমি নিজে গিয়ে ডেকে এনো। আজই, দেরি কোরো না ।” দাদাকে ঠকিয়ে নবীনের মনের ভিতরটাতে অত্যন্ত অস্বস্তিবোধ হতে লাগল । ফন্দিটা এত সহজ, এর সফলতাটা দাদার পক্ষে এত হাস্যকর যে, তারই অমর্যাদায় ওকে লজা ও কষ্ট দিলে । দাদাকে উপস্থিতমত ছোটাে অনেক ফাকি অনেকবার দিতে হয়েছে, কিছু মনে হয় নি ; কিন্তু এত করে সাজিয়ে এতবড়ো ফাকি গড়ে তোলার গ্লানি ওর চিত্তকে অশুচি করে রেখে দিলে । . 8 NR মধুসূদনের মন থেকে মস্ত একটা ভার গেল নেমে, আত্মগৌরবের ভার- যে কঠোর গীেরব-বোধ ওর বিকাশোন্মুখ অনুরক্তিকে কেবলই পাথর-চাপা দিয়েছে। কুমুর প্রতি ওর মন যখন মুগ্ধ তখনো সেই বিহবলতার বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে চলেছিল। লড়াই। যতই অনন্যগতি হয়ে কুমুর কাছে ধরা দিয়েছে, ততই নিজের অগোচরে কুমুর পরে ওর ক্ৰোধ জমেছে। এমন সময় স্বয়ং নক্ষত্রদের কাছ থেকে যখন আদেশ এল যে, লক্ষ্মী এসেছেন ঘরে, তঁাকে খুশি করতে হবে, সকল দ্বন্দ্ব ঘুচে গিয়ে ওর দেহ,মন যেন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল ; বার বার আপন মনে আবৃত্তি করতে লািগল— লক্ষ্মী, আমারই ঘরে লক্ষ্মী, আমার ভাগ্যের পরম দান । ইচ্ছে করতে লাগিল- এখনই সমস্ত সংকোচ ভাসিয়ে দিয়ে কুমুর কাছে স্তুতি জানিয়ে আসে, বলে আসে, “যদি কোনো ভুল করে থাকি, অপরাধ নিয়ো না।” কিন্তু আজ আর সময় নেই, ব্যবসায়ের ভাঙন সারবার কাজে এখনই আপিসে ছুটতে হবে, বাড়িতে খেয়ে যাবার অবকাশ পর্যন্ত জুটল না। এ দিকে সমস্তদিন কুমুর মনের মধ্যে তোলপাড় চলেছে। সে জানে কাল দাদা আসবেন, শরীর র্তার অসুস্থ। তার সঙ্গে দেখাটা সহজ হবে কি না নিশ্চিত জানবার জন্যে মন উদবিগ্ন হয়ে আছে। নবীন কোথায় কাজে গেছে, এখনাে এল না। সে নিঃসন্দেহ জানত আজ স্বয়ং মধুসূদন এসে বউরানীকে সকল রকমে প্রসন্ন করবে ; আগেভাগে কোনো আভাস দিয়ে রসভঙ্গ করতে চায় না । আজ ছাতে বসবার সুবিধা ছিল না। কাল সন্ধ্যা থেকে মেঘ করে আছে, আজ দুপুর থেকে টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। শীতকালের বাদলা, অনিচ্ছিত অতিথির মতো। মেঘে রঙ নেই, বৃষ্টিতে ধ্বনি নেই, ভিজে বাতাসটা যেন মনমরা, সূর্যালোেকইন আকাশের দৈন্যে পৃথিবী সংকুচিত। সিঁড়ি থেকে উঠেই শোবার ঘরে ঢোকবার পথে যে ঢাকা ছাদ আছে সেইখানে কুমু মাটিতে বসে। থেকে থেকে গায়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। আজ এই ছায়ান্নান আর্দ্র একঘেয়ে দিনে কুমুর মনে হল, তার নিজের জীবনটা তাকে যেন অজগরের মতাে গিলে ফেলেছে, তারই ক্লেদাক্ত জঠরের রুদ্ধতার মধ্যে কোথাও একটুমাত্র ফাক নেই। যে দেবতা ওকে ভুলিয়ে আজ এই নিরুপায় নৈরাশ্যের মধ্যে এনে ফেললে তার উপরে যে অভিমান ওর মনে ধোয়াচ্ছিল আজ সেটা ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠল। হঠাৎ দ্রুত উঠে পড়ল। ডেস্ক খুলে বের করলে সেই যুগলরাপের পাট । রঙিন রেশমের ছিট দিয়ে সেটা মোড়া । সেই পট আজ ও নষ্ট করে ফেলতে চায়। যেন চীৎকার করে বলতে চায়, তোমাকে আমি একটুও বিশ্বাস করি নে। হাত কঁািপছে, তাই গ্ৰন্থি খুলতে পারছে না ; টানাটানিতে সেটা আরো আঁট হয়ে উঠল, অধীর হয়ে দাঁত দিয়ে ছিড়ে ফেললে অমনি চিরপরিচিত সেই মূর্তি অনাবৃত হতেই আর সে থাকতে পারলে না ; তাকে বুকে চেপে ধরে কেঁদে উঠল। কাঠের ফ্রেম বুকে যত বাজে ততই আরো বেশি চেপে ধরে । ,戟