পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8の8 রবীন্দ্র-রচনাবলী করবার কোথাও কেউ নেই ?” নবীনের চোখ জলে ভেসে উঠল। “দাদাকে উদ্দেশ করে আমাকে কিছু করতেই হবে ঠাকুরপো, কিছু দিতেই হবে । এই বালা আমার মায়ের, সেই আমার মায়ের হয়েই এ বালা আমার দেবতাকে আমি দেব ।” “দেবতাকে হাতে করে দিতে হয় না বউরানী, তিনি এমনি নিয়েছেন। দুদিন অপেক্ষা করো, যদি দেখ তিনি প্ৰসন্ন হন নি, তা হলে যা বলবে তাই করব । যে দেবতা তোমাকে দয়া করেন না। তাকেও ভোগ দিয়ে আসিব ।” রাত্রি অন্ধকার হয়ে এল- বাইরে সিঁড়িতে ঐ সেই পরিচিত জুতোর শব্দ । নবীন চমকে উঠল, বুঝলে দাদা আসছে। পালিয়ে গেল না, সাহস করে দাদার জন্যে অপেক্ষা করেই রইল। এ দিকে কুমুর মন এক মুহুর্তে নিরতিশয় সংকুচিত হয়ে উঠল। এই অদৃশ্য বিরোধের ধাক্কাটা এমন প্রবল বেগে যখন তার প্রত্যেক নাড়িকে চমকিয়ে তুললে বড়ো ভয় হল । এ পাপ কেন তাকে এত দুৰ্জয় বলে পেয়ে বসেছে ? r হঠাৎ কুমু নবীনকে জিজ্ঞাসা করলে, “ঠাকুরপো, কাউকে জান যিনি আমাকে গুরুর মতো উপদেশ দিতে পারেন ?” “কী হবে বউরানী ?” “নিজের মনকে নিয়ে যে পেরে উঠছি নে ৷” “বিপদটা বাইরের, দোষটা মনের, দাদার কাছে এই কথা বার বার শুনেছি।” “তোমার দাদাই তোমাকে উপদেশ দেবেন- ভয় কোরো না ।” “সেদিন আমার আর আসবে না ।” মধুসূদনের বিষয়বুদ্ধির সঙ্গে তার ভালোবাসার আপস হয়ে যেতেই সেই ভালোবাসা মধুসূদনের সমস্ত কাজকর্মের উপর দিয়েই যেন উপছে বয়ে যেতে লাগল। কুমুর সুন্দর মুখে তার ভাগ্যের বরাভয় দান । পরাভবটি কেটে যাবে আজই পেল তার আভাস । কাল যারা বিরুদ্ধে মত দিয়েছিল। আজ তাদেরই মধ্যে কেউ কেউ সুর ফিরিয়ে ওকে চিঠি লিখেছে। মধুসূদন যেই তালুকটা নিজের নামে কিনে নেবার প্রস্তাব করলে অমনি কারও কারও মনে হল ঠিকলম বুঝি। কেউ কেউ এমনও ভাব প্ৰকাশ করলে যে, কথাটা আর-একবার বিচার করা উচিত । গরহাজির অপরাধে আপিসের দারোয়ানের অর্ধেক মাসের মাইনে কাটা গিয়েছিল, আজ টিফিনের সময় মধুসূদনের পা জড়িয়ে ধরাবামাত্ৰ মধুসূদন তাকে মাপ কৰি দিলে। মাপ করবার মানে নিজের পুঞ্জ থেকে পারোয়ানের ক্ষতিপূর্ণ ব্যক্তি খাতায় জরিমানা রয়ে গেল। নিয়মের ব্যতায় হবার জে আজকের দিনটা মধুর পক্ষে বড়ো আশ্চর্যের দিন। বাইরে আকাশটা মেঘে ঘোলা, টিপ টপ করে বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু এতে করে ওর ভিতরের আনন্দ আরো বাড়িয়ে দিলে। আপিস থেকে ফিরে এসে রাত্রে আহারের সময়ের পূর্বে পর্যন্ত মধুসূদন বাইরের ঘরে কাটাত। বিয়ের পরে কয়দিন অসময়ে নিয়মের বিরুদ্ধে অন্তঃপুরে যাবার বেলায় লোকের দৃষ্টি এড়াবার চেষ্টা করেছে। আজ সশব্দ পদক্ষেপে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে যেন জানিয়ে দিতে চাইলে যে, সে চলেছে কুমুর সঙ্গে দেখা করতে। আজ বুঝেছে পৃথিবীর লোকে ওকে ঈর্ষা করতে পারে এতবড়ো - ওর সৌভাগ্য । খানিকক্ষণের জন্যে বৃষ্টি ধরে গেছে। তখনাে সব ঘরে আলো জ্বলে নি। আন্দিবুড়ি ধুনুচি হাতে ধুনাে দিয়ে বেড়াচ্ছে, একটা চামচিকে উঠোনের উপরের আকাশ থেকে লণ্ঠনজ্বালা অন্তঃপুরের পথ পর্যন্ত কেবলই চক্রপথে ঘুরছে। বারান্দায় পা মেলে দিয়ে দাসীরা উরুর উপরে প্রদীপের সলতে পাকাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি উঠে ঘোমটা টেনে দৌড় দিলে। পায়ের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল শ্যামাসুন্দরী, হাতে বাটাতে ছিল পান। মধুসূদন আপিস থেকে এলে নিয়মমত এই পান সে বাইরে