পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8S 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সেইজন্যেই যখন উনি ভালোবাসেন তখনই আমার সব চেয়ে বেশি ভয় করে। আমি নিজের মধ্যে যে কিছুই খুঁজে পাই নে। এতবড়ো ফাকি নিয়ে আমি ওঁর সেবা করব কী করে ? কাল রাত্তিরে বসে বসে মনে হল আমি যেন বেয়ারিং লেফাফা, আমাকে দাম দিয়ে নিতে হয়েছে, খুলে ফেললেই ধরা পড়বে যে ভিতরে চিঠিও নেই।” “দিদি হাসালে । বড়েঠাকুরের মস্তবড়ো কারবার, কারবারি বুদ্ধিতে ওঁর সমান কেউ নেই, সব জানি। কিন্তু তুমি কি ওঁর কারবারের ম্যানেজারি করতে এসেছি যে যোগ্যতা নেই বলে ভয় পাবে ? বড়েঠাকুর যদি মনের কথা খোলসা করে বলেন তবে নিশ্চয় বলবেন, তিনিও তোমার যোগ্য নন।” “সে কথা তিনি আমাকে বলেছিলেন ।” “বিশ্বাস হয় নি ?” “না। উলটে আমার ভয় হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমার সম্বন্ধে ভুল করলেন, সে ভুল ধরা পড়বে।” “কেন তোমার এমন মনে হল বলো দেখি ।” “বলব ? এই-যে আমার হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল, এ তো সমস্ত আমি নিজে ঘটিয়ে তুললুম।— কিন্তু কী অদ্ভুত মােহে, কী ছেলেমানুষি করে ! যা-কিছুতে আমাকে সেদিন ভুলিয়েছিল তার মধ্যে সমস্তই ছিল ফাকি । অথচ এমন দৃঢ় বিশ্বাস, এমন বিষম জেদ যে, সেদিন আমাকে কিছুতেই কেউ ঠেকাতে পারত না । দাদা তা নিশ্চিত জানতেন বলেই বৃথা বাধা দিলেন না ; কিন্তু কত ভয় পেয়েছেন, কত উদবিগ্ন হয়েছেন, তা কি আমি বুঝতে পারি নি ? বুঝতে পেরেও নিজের ঝোকটাকে একটুও সামলাই নি, এতবড়ো অবুঝ আমি । আজ থেকে চিরদিন আমি কেবলই কষ্ট পাব, কষ্ট দেব, আর প্রতিদিন মনে জানব। এ সমস্তই আমার নিজের সৃষ্টি ।” মোতির মা কী যে বলবে কিছুই ভেবে পেলে না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলে, “আচ্ছা দিদি, তুমি যে বিয়ে করতে মন স্থির করলে, কী ভেবে ?” “তখন নিশ্চিত জানতুম, স্বামী ভালোমন্দ যাই হােক-না কেন, স্ত্রীর সতীত্বগৌরব প্রমাণের একটা উপলক্ষমাত্র । মনে একটুও সন্দেহ ছিল না যে, প্রজাপতি যাকেই স্বামী বলে ঠিক করে দিয়েছেন তাকেই ভালোবাসবই । ছেলেবেলা থেকে কেবল মাকে দেখেছি, পুরাণ পড়েছি, কথকতা শুনেছি, মনে হয়েছে। শাস্ত্রের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে চলা খুব সহজ ।” “দিদি, উনিশ বছরের কুমারীর জন্যে শাস্ত্র লেখা হয় নি।” “আজি বুঝতে পেরেছি। সংসারে ভালোবাসাটা উপরি-পাওনা। ওটাকে বাদ দিয়েই ধর্মকে আঁকড়ে ধরে সংসারসমুদ্রে ভাসতে হবে । ধর্ম যদি সরস হয়ে ফুল না দেয়, ফল না দেয়, অন্তত শুকনো হয়ে যেন ভাসিয়ে রাখে ।” মোতির মা নিজে বিশেষ কিছু না বলে কুমুকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিতে লাগল। 80 মধুসূদন আপিসে গিয়েই দেখলে খবর ভালো নয়। মাদ্রাজের এক বড়ো ব্যাঙ্ক ফেল করেছে, তাদের সঙ্গে এদের কারবার। তার পরে কানে এল যে, কোনো ডাইরেক্টরের তরফ থেকে কোনো কর্মচারী মধুসূদনের অজানিতে খাতাপত্র ঘাটাঘাঁটি করছে। এতদিন কেউ মধুসূদনকে সন্দেহ করতে সাহস করে নি, একজন যেই ধরিয়ে দিয়েছে অমনি যেন একটা মন্ত্রশক্তি ছুটে গৈল। বড়ো কাজের ছোটাে ক্রটি ধরা সহজ, যারা মাতব্বর সেনাপতি তারা কত খুচরো হারের ভিতর দিয়ে মোটের উপর মন্ত করেই জেতে। মধুসূদন বরাবর তেমনি জিতেই এসেছে- তাই বেছে বেছে খুচরো হার কারও নজরেই পড়ে নি। কিন্তু বেছে বেছে তারই একটা ফৰ্দ বানিয়ে সেটা সাধারণ লোকের নজরে তুললে । তারা নিজের বুদ্ধির তারিফ করে, বলে আমরা হলে এ ভুল করতুম না। কে তাদের বােঝাবে যে, ফুটাে নীেকো নিয়েই মধুসূদন পাড়ি দিয়েছে, নইলে পাড়ি দেওয়াই হত না, আসল কথাটা এই যে কুলে