পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 NO রবীন্দ্র-রচনাবলী কুমু তৎক্ষণাৎ বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরে চলে গেল। মধুসূদন বাইরের ঘরে যাবার পথে দেখলে শ্যামাসুন্দরী সেই বারান্দায় উপুড় হয়ে পড়ে। মধুসূদন পাশে এসে নিচু হয়ে তার হাত ধরে টেনে তোেলবার চেষ্টা করে বললে, “কী করছ, শ্যামা ?” আমনি শ্যামা উঠে বসে মধুসূদনের দুই পা বুকে জড়িয়ে ধরলে, গদগদ কণ্ঠে বললে, “আমাকে মেরে ফেলো " "মরুন তাকে হাত ধরে তুলে দাঁড় করলে বললে, “ইস তােমার গা যে একেবারে ঠাণ্ড হিম। চলো তোমাকে শুইয়ে দিয়ে আসি গে।” বলে তাকে নিজের শালের এক অংশে আবৃত করে ডান হাত দিয়ে সবলে চেপে ধরে শোবার ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে এল। শ্যামা চুপি চুপি বললে, “একটু বসবে না ?” মধুসূদন বললে, “কাজ আছে।” রাতের বেলা কোথা থেকে ভূত চেপে এতক্ষণ মধুসূদনের কাজ নষ্ট করে দেবার জোগাড় করেছে- আর নয়। কুমুর কাছ থেকে যে উপেক্ষা পেয়েছে তার ক্ষতিপূরণের ভাণ্ডার অন্য কোথাও জমা আছে এটুকু সে বুঝে নিলে। ভালোবাসার ভিতর দিয়ে মানুষ আপনার যে পরম মূল্য উপলব্ধি করে, আজ রাত্রে সেই অনুভব করবার প্রয়োজন মধুসূদনের ছিল । শ্যামাসুন্দরী সমস্ত জীবনমন দিয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করে আছে, সেই আশ্বাসটুকু পেয়ে মধুসূদন আজ রাত্রে কাজের জোর পেলে, যে অমর্যাদার কাটা ওর মনের মধ্যে বিধে আছে তার বেদনা অনেকটা কমিয়ে দিলে । এ দিকে রাত্রে কুমু যে ধাক্কা পেলে তার মধ্যে ওর একটা সান্তুনা ছিল। যতবার মধুসূদন তাকে ভালোবাসা দেখিয়েছে, ততবারই কুমুর মনে একটা টানাটানি এসেছে ; ভালোবাসার মূল্যেই এর পরিশোধ করা চাই এই কর্তব্যবোধে ওকে অত্যন্ত অস্থির করেছে। এ লড়াইয়ে কুমুর জেতবার কোনো আশা ছিল না । কিন্তু পরাভবটা কুশ্রী, সেটাকে কেবলই চাপা দেবার জন্যে এতদিন কুমু প্ৰাণপণে চেষ্টা করেছে। কাল রাত্রে সেই চাপা-দেওয়া পরাভবটা এক মুহুর্তে সম্পূর্ণ ধরা পড়ে গেল। কুমুর অসতর্ক অবস্থায় মধুসূদন স্পষ্ট করে দেখতে পেয়েছে যে কুমুর সমস্ত প্রকৃতি মধুসূদনের প্রকৃতির বিরুদ্ধ , এইটে নিশ্চিত জানা হয়ে গেল সে ভালো, তার পরে পরস্পরের যা কর্তব্য সেটা অকপটভাবে করা সম্ভব হবে । মধুসূদন ওকে কামনা করে, সেইখানেই সমস্যা ; ক্ষোভের সঙ্গে ওকে যে বর্জন করতে চায় সেইখনেই সত্য । সত্যই মধুসূদনের বিছানায় শোবার অধিকার ওর নেই। শুয়ে ও কেবলই ফাঁকি দিচ্ছে। এ বাড়িতে ওর যে-পদ সেটা বিড়ম্বনা । আজ রাত্রে এই একটা প্রশ্ন বার বার কুমুর মনে উঠেছে— কুমুকে নিয়ে মধুসূদনের কেন এত নির্বন্ধ ? ও তো কথায় কথায় নুরনগরি চালের প্রসঙ্গ তুলে কুমুকে খোটা দেয়, তার মানে কুমুর সঙ্গে ওদের একেবারে ধাতের তফাত, জাতের তফাত, কিন্তু মধুসূদন কেন তবে ওকে ভালোবাসা জানায় ? একি কখনো সত্য ভালোবাসা হতে পারে ? কুমুর নিশ্চয় বিশ্বাস, আজ মধুসূদন যাই মনে করুক-না কেন, কুমুকে দিয়ে কখনােই ওর মন ভারতে পারে না। যত শীঘ্ৰ মধুসূদন তা বােঝে ততই সকল পক্ষের মঙ্গল। নবীন কাল রাত্রে দাদার কাছ থেকে সম্মতি নিয়ে যত আনন্দ করে শুতে গেল, আজ সকালে তার আর বড়ো-কিছু বাকি রইল না। কাল রাত্রি তখন আড়াইটা। মধুসূদন কাজ শেষ করে তখনই • নবীনকে ডেকে পাঠিয়েছিল। হুকুম এই যে, কুমুদিনীকে বিপ্রদাসের ওখানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, যতদিন মধুসূদন না। আপনি ডেকে পাঠায় ততদিন ফিরে আসার দরকার নেই। নবীন বুঝলে এটা নির্বাসনদণ্ড । আঙিনা-ঘেরা চৌকো বারান্দার যে অংশে কাল রাত্রে মধুসূদনের সঙ্গে শ্যামার সাক্ষাৎ হয়েছিল, ঠিক তার বিপরীত দিকের বারান্দার সংলগ্ন নবীনের শোবার ঘর। তখন ওরা স্বামীশ্ৰী কুমুর সম্বন্ধেই আলোচনা করছিল এমন সময় গলার শব্দ শুনে মেতির মা ঘরের দরজা খুলতেই জ্যোৎস্নার আলোতে মধুসূদনের সঙ্গে শ্যামার মিলনের ছবি দেখতে পেলে। বুঝতে পারলে কুমুর ভাগ্যের জালে এই রাত্রে নিঃশব্দে আর-একটা শক্ত গিঠ পড়ল।