পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 SR SR রবীন্দ্র-রচনাবলী বার-বাড়ির আঙিনা পার হয়ে অন্তঃপুরের দিকে পালকি চলেছিল। কুমু থামিয়ে দ্রুতপদে বাইরের সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠে চলল। তার ইচ্ছে তাকে আর কেউ দেখবার আগে সব প্রথমেই দাদার সঙ্গে তার দেখা হয়। নিশ্চয় সে জানত, বাইরের আরাম-কামরাতেই রোগীর থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। ওখানে জানলা থেকে বাগানের কৃষ্ণচূড়া, কাঞ্চন ও অশথ গাছের একটি কুঞ্জসভা দেখতে পাওয়া যায়। সকালের রোদুর ডালপালার ভিতর দিয়ে এই ঘরেই প্রথম দেখা দেয়। এই ঘরটিই বিপ্রদাসের °छ्मा । i ጽ কুমু সিঁড়ির কাছে আসতেই সর্বাগ্রে টম কুকুর ছুটে এসে ওর গায়ের পরে ঝাপিয়ে পড়ে চেচিয়ে লেজ ঝাপটিয়ে অস্থির করে দিলে। কুমুর সঙ্গে সঙ্গেই লাফাতে লাফাতে চেঁচাতে চেঁচাতে টম চলল। বিপ্রদাস একটা মুড়ে-তোলা কীেচের পিঠে হেলান দিয়ে আধ-শোওয়া অবস্থায়, পায়ের উপর একটা । ছিটের বাল্যাপোশ টানা ; একখানা বই নিয়ে ডান হাতটা বিছানার উপর এলিয়ে আছে, যেন ক্লান্ত হয়ে একটু আগে পড়া বন্ধ করেছে। চায়ের পেয়ালা আর ভুক্তাবিশিষ্ট রুটি সমেত একটা পিরিচ পাশে মেজের উপরে পড়ে। শিয়রের কাছে দেয়ালের গায়ের শেলফে বইগুলো উলটাপালট এলোমেলো । রাত্রে যে ল্যাম্প জ্বলেছিল সেটা ধোয়ায় দাগি অবস্থায় ঘরের কোণে এখনো পড়ে আছে । কুমু বিপ্রদাসের মুখের দিকে চেয়ে চমকে উঠল। ওর এমন বিবৰ্ণরুগণ মূর্তি কখনো দেখে নি । সেই বিপ্রদাসের সঙ্গে এই বিপ্রদাসের যেন কত যুগের তফাত ! দাদার পায়ের তলায় মাথা রেখে কুমু दैोऊ लां१ळ | “কুমু যে, এসেছিস ? আয়, এইখানে আয় ।” বলে বিপ্রদাস তাকে পাশে টেনে নিয়ে এল। যদিও চিঠিতে বিপ্রদাস তাকে আসতে একরকম বারণ করেছিল, তবু তার মনে আশা ছিল যে কুমু আসবে। আসতে পেরেছে দেখে ওর মনে হল, তবে হয়তো কোনো বাধা নেই- তবে কুমুর পক্ষে তার ঘরকন্না সহজ হয়ে গেছে। এদের পক্ষ থেকেই কুমুকে আনবার জন্যে প্রস্তাব, পালকি ও লোক পাঠানোই নিয়ম- কিন্তু তা না হওয়া সত্ত্বেও কুমু এল, এটাতে ওর যতটা স্বাধীনতা কল্পনা করে নিলে ততটা মধুসূদনের ঘরে বিপ্রদাস একেবারেই প্রত্যাশা করে নি। - কুমু তার দুই হাত দিয়ে বিপ্রদাসের আলুথালু চুল একটু পরিপাটি করতে করতে বললে, “দাদা, তোমার এ কী চেহারা হয়েছে !” -- “আমার চেহারা ভালো হবার মতো ইদানীং তো কোনো ঘটনা ঘটে নি- কিন্তু তোর এ কী রকম শ্ৰী ! ফ্যাকাশে হয়ে গেছিস যে ।” ইতিমধ্যে খবর পেয়ে ক্ষেমপিসি এসে উপস্থিত । সেইসঙ্গে দরজার কাছে একদল দাসী চাকর ভিড় করে জমা হল। ক্ষেমপিসিকে প্ৰণাম করতেই পিসি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলে। দাসদাসীরা এসে প্ৰণাম করলে। সকলের সঙ্গে কুশলসম্ভাষণ হয়ে গেলে পর কুমু বললে, “পিসি, দাদার চেহারা বড়ো খারাপ হয়ে গেছে।” “সাধে হয়েছে ! তোমার হাতের সেবা না পেলে ওর দেহ যে কিছুতেই ভালো হতে চায় না । কতদিনের অভ্যোস ।” বিপ্ৰদাস বললে, “পিসি, কুমুকে খেতে বলবে না ?” “খাবে না তো কী ! সেও কি বলতে হবে ? ওদের পালকির বেহারা-দরোয়ান সবাইকে বসিয়ে এসেছি, তাদের খাইয়ে দিয়ে আসি গে। তোমরা দুজনে এখন গল্প করো, আমি চললুম।” বিপ্রদাস ক্ষেমপিসিকে ইশারা করে কাছে ডেকে কানে কানে কিছু বলে দিলে। কুমু বুঝলে ওদের বাড়ির লোকদের কী ভাবে বিদায় করতে হবে তারই পরামর্শ। এই পরামর্শের মধ্যে কুমু আজ অপর পক্ষ হয়ে উঠেছে। ওর কোনো মত নেই। এটা ওর একটুও ভালো লাগল না। কুমুও তার শোধ তুলতে বসল। এ বাড়িতে তার চিরকালের স্থান ফিরে দখলের কাজ শুরু করে দিলে । প্রথমত, দাদার খানসামা গোকুলকে ফিসফিস করে কী একটা হুকুম করলে, তার পরে লাগল নিজের মনের মতো করে ঘর গোছাতে। বাইরের বারান্দায় সরিয়ে দিলে পিরিচ, পেয়ালা, ল্যাম্প, খালি