পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8&8 রবীন্দ্র-রচনাবলী স্কুলহস্তাবলেপ থেকে কুমুকে উদ্ধার করবার তো কোনাে উপায় নেই। সকলের চেয়ে মুশকিল এই যে, এই মানুষের কাছে ঋণে ওর সমস্ত সম্পত্তি বাধা । এই অপমানিত সম্বন্ধের ধাক্কা যে কুমুকেও লাগছে। এতদিন রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে বিপ্ৰদাস কেবলই ভেবেছে মধুসূদনের এই ঋণের বন্ধন থেকে কেমন করে সে নিস্কৃতি পাবে। ওর কলকাতায় আসবার ইচ্ছে ছিল না, পাছে কুমুর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ওদের সহজ ব্যবহার অসম্ভব হয়। কুমুর উপর ওর যে স্বাভাবিক মেহের অধিকার আছে, পাছে তা পদে পদে লাঞ্ছিত হতে থাকে, তাই ঠিক করেছিল নুরনগরেই বাস করবে। কলকাতায় আসতে বাধ্য হয়েছে অন্য কোনো মহাজনের কাছ থেকে ধার নেবার ব্যবস্থা করবে বলে । জানে যে এটা অত্যন্ত দুঃসাধ্য, তাই এর দুশ্চিন্তার বোঝা ওর বুকের উপর চেপে বসে আছে। খানিক বাদে কুমু বিপ্রদাসের থেকে অন্য দিকে ঘাড় একটু বেঁকিয়ে বললে, “আচ্ছা দাদা, স্বামীর ’পরে কোনোমতে মন প্ৰসন্ন করতে পারছি নে, এটা কি আমার পাপ ?” “কুমু তুই তো জানিস, পাপপুণ্য সম্বন্ধে আমার মতামত শাস্ত্রের সঙ্গে মেলে না।” অন্যমনস্কভাবে কুমু একটা ছবিওয়ালা ইংরেজি মাসিক পত্রের পাতা ওলটাতে লাগল। বিপ্রদাস বললে, “ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জীবন তার ঘটনায় ও অবস্থায় এতই ভিন্ন হতে পারে যে, ভালোমন্দর সাধারণ নিয়ম অত্যন্ত পাকা করে বেঁধে দিলে অনেক সময়ে সেটা নিয়মই হয়, ধর্ম হয় না ।” কুমু মাসিক পত্রটার দিকে চোখ নিচু করে বললে, “যেমন মীরাবাই-এর জীবন ৷” নিজের মধ্যে কর্তব্য-অকর্তব্যের দ্বন্দ্ব যখনই কঠিন হয়ে উঠেছে, কুমু তখনই ভেবেছে মীরাবাই-এর কথা। একান্ত মনে ইচ্ছা করেছে। কেউ ওকে মীরাবাই-এর আদর্শটা ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। কুমু একটু চেষ্টা করে সংকোচ কাটিয়ে বলতে লাগল, “মীরাবাই আপনার যথার্থ স্বামীকে অন্তরের মধ্যে পেয়েছিলেন বলেই সমাজের স্বামীকে মন থেকে ছেড়ে দিতে পেরেছিলেন, কিন্তু সংসারকে ছাড়বার সেই বড়ো অধিকার কি আমার আছে ?” বিপ্রদাস বললে, “কুমু, তোর ঠাকুরকে তুই তো সমস্ত মন দিয়েই পেয়েছিস ।” “এক সময়ে তাই মনে করেছিলুম। কিন্তু যখন সংকটে পড়লুম। তখন দেখি প্ৰাণ আমার কেমন শুকিয়ে গেছে, এত চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতে র্তাকে যেন আমার কাছে সত্য করে তুলতে পারছি নে! আমার সব চেয়ে দুঃখ সেই ।” “কুমু, মনের মধ্যে জোয়ার-ভাটা খেলে। কিছু ভয় করিস নে, রাত্তির মাঝে মাঝে আসে, দিন তা বলে তো মরে না । যা পেয়েছিস তোর প্রাণের সঙ্গে তা এক হয়ে গেছে ।” “সেই আশীর্বাদ করো, তাকে যেন না হারাই। নির্দয় তিনি দুঃখ দেন, নিজেকে দেবেন বলেই। দাদা, আমার জন্যে ভাবিয়ে আমি তোমাকে ক্লান্ত করছি।” “কুমু, তোর শিশুকাল থেকে তোর জন্যে ভাবা যে আমার অভ্যোস । আজ যদি তোর কথা জানা বন্ধ হয়ে যায়, তোর জন্যে ভাবতে না পাই, তা হলে শূন্য ঠেকে। সেই শূন্যতা হাতড়াতে গিয়ে তো মন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।” কুমু বিপ্রদাসের পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে, “আমার জন্যে তুমি কিন্তু কিছু ভেবো না দাদা। আমাকে যিনি রক্ষা করবেন। তিনি ভিতরেই আছেন, আমার বিপদ নেই।” প্রশ্ন থাক ও সব কথা। তােকে যেমন গান লেখাতুম, ইচ্ছে করছে তেমনি করে আজ তােকে শেখাই ।” “ভাগ্যি শিখিয়েছিলে দাদা, ওতেই আমাকে বীচায়। কিন্তু আজ নয়, তুমি আগে একটু জোর পাও ৷ আজ আমি বরঞ্চ তোমাকে একটা গান শোনাই ।” • দাদার শিয়রের কাছে বসে কুমু আস্তে আস্তে গাইতে লাগলপিয়া ঘর আয়ে, সোহী পীতম পিয় প্যার রে । মীরাকে প্ৰভু গিরিধর নাগর, . . . চরণকমল বলিহার রে।