পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Sby রবীন্দ্র-রচনাবলী । “কিসের থেকে বুঝলি ?” ...' “তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি। আচ্ছা, আমি কি কিছুই করতে পারি। নে ?” “কী করে বলে ?” । “এই মনে করো, কোনাে দলিলে সই করে। আমার সইয়ের কি কোনাে দামই নেই ?” “খুবই দাম আছে ; সে আমাদের কাছে, মহাজনের কাছে নয়।” “লক্ষ্মী হয়ে শান্ত হয়ে থাক, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর, মনে রাখিস সংসারে সেও একটা মস্ত কাজ । তুফানের মুখে নীেকো ঠিক রাখাও যেমন একটা কাজ, মাথা ঠিক রাখাও তেমনি। আমার এসরাজটা নিয়ে আয়, একটু বাজা ।” “দাদা, আমার বড়ো ইচ্ছে করছে একটা কিছু করি।” “বাজানোটা বুঝি একটা কিছু নয় ।” A“আমি চাই খুব একটা শক্ত কাজ ।” “দলিলে নাম সই করার চেয়ে এসরাজ বাজানো অনেক বেশি শক্ত | আন যন্ত্রটা ।” 8br একদিন মধুসূদনকে সকলেই যেমন ভয় করত, শ্যামাসুন্দরীরও ভয় ছিল তেমনি । ভিতরে ভিতরে মধুসূদন তার দিকে কখনাে কখনাে যেন টলেছে, শ্যামাসুন্দরী তা আন্দাজ করেছিল। কিন্তু কোন দিক দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে যে ওর কাছে যাওয়া যায় তা ঠাহর করতে পারত না । হাতড়ে হাতড়ে মাঝে মাঝে চেষ্টা করেছে, প্রত্যেকবার ফিরেছে। ধাক্কা খেয়ে । মধুসূদন একনিষ্ঠ হয়ে ব্যাবসা গড়ে তুলছিল, কাঞ্চনের সাধনায় কামিনীকে সে অত্যন্তই তুচ্ছ করেছে, মেয়েরা সেইজন্যে ওকে অত্যন্তই ভয় করত। কিন্তু এই ভয়েরও একটা আকর্ষণ আছে। দুরু দুরু বক্ষ এবং সংকুচিত ব্যবহার নিয়েই শ্যামাসুন্দরী ঈষৎ একটা আবরণের আড়ালে মুগ্ধমনে মধুসূদনের কাছে কাছে ফিরেছে। এক-একবার যখন অসতর্ক অবস্থায় মধুসূদন ওকে অল্প একটু প্রশ্রয় দিয়েছে, সেই সময়েই যথার্থ ভয়ের কারণ ঘটেছে ; তার অনতিপরেই কিছুদিন ধরে বিপরীত দিক থেকে মধুসূদন প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছে। ওর জীবনে মেয়েরা একেবারেই হেয় । তাই এতকাল শ্যামাসুন্দরী নিজেকে খুবই সংযত করে রেখেছিল। মধুসূদনের বিয়ের পর থেকে সে আর থাকতে পারছিল না। কুমুকে মধুসূদন যদি অন্য সাধারণ মেয়ের মতোই অবজ্ঞা করত, তা হলে সেটা একরকম সহ্য হত । কিন্তু শ্যামা যখন দেখলে রািশ আলগা দিয়ে মধুসূদনও কোনো মেয়েকে নিয়ে অন্ধবেগে মেতে উঠতে পারে, তখন সংযম রক্ষা তার পক্ষে আর সহজ রইল না । এ কয়দিন সাহস করে যখন তখন একটু একটু এগিয়ে আসছিল, দেখেছিল এগিয়ে আসা চলে । মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প বাধা পেয়েছে কিন্তু সেও দেখলে কেটে যায় । মধুসূদনের দুর্বলতা ধরা পড়েছে, সেইজন্যেই শ্যামার নিজের মধ্যেও ধৈর্য বঁাধ মানতে আর পারে না | কুমু চলে আসবার আগের রাত্রে মধুসূদন শ্যামাকে যত কাছে টেনেছিল এমন তো আর কখনোই হয় নি। তার পরেই ওর ভয় হল পাছে উলটাে ধাক্কাটা জোরে এসে লাগে। কিন্তু এটুকু শ্যামা বুঝে নিয়েছে যে, ভীরুতা যদি না করে তবে ভয়ের কারণ আপনি কেটে যাবে। সকালেই মধুসূদন বেরিয়ে গিয়েছিল, বেলা একটা পেরিয়ে বাড়ি এসেছে। ইদানীং অনেক কাল ধরে ওর মানাহারের নিয়মের এমন ব্যতিক্রম ঘটে নি। আজ বড়োই ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বাড়িতে যেই এল, প্রথম কথাই মনে হল, কুমুতার দাদার ওখানে চলে গেছে এবং খুশি হয়েই চলেগেছে। এতকাল মধুসূদন আপনাতে আপনি খাড়া ছিল, কখন এক সময়ে চিল দিয়েছে, শরীরমনের আতুরতার সময় কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আশ্রয় করবার সুপ্ত ইচ্ছা ওর মনে উঠেছে জেগে, সেইজন্যেই অনায়াসে কুমুর চলে যাওয়াতে ওর এমন ধিক্কার লাগল। আজ ওর খাবার সময়ে শ্যামাসুন্দরী ইচ্ছা করেই