পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 V8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি তার মধ্যেই এসরাজ বাজাব- ভীমপলশ্ৰী ।” “আচ্ছা, তাতেই রাজি ।” আধঘণ্টা পরে এসরাজ হাতে করেই কুমু ঘরে ঢুকল, কিন্তু বিপ্ৰদাসের মুখের ভাব দেখে তখনই এসরাজটা দেয়ালের কোণে ঠেকিয়ে রেখে দাদার পাশে বসে তার হাত চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলে, “কী হয়েছে দাদা ?” কুমু এতদিন বিপ্রদাসের মধ্যে যে অস্থিরতা লক্ষ্য করেছিল তার মধ্যে একটা গভীর বিষাদ ছিল। বিপ্রদাসের জীবনে দুঃখতাপ অনেক গেছে, কেউ তাকে সহজে বিচলিত হতে দেখে নি। বই পড়া, গানবাজনা করা, দুরবীন নিয়ে তারা দেখা, ঘোড়ায় চড়া, নানা জায়গা থেকে অজানা গাছপালা নিয়ে বাগান করা প্রভৃতি নানা বিষয়েই তার ঔৎসুক্য থাকাতে সে নিজের সম্বন্ধীয় দুঃখকষ্টকে নিজের মধ্যে কখনো জমতে দেয় নি । এবার রোগের দুর্বলতায় তাকে নিজের ছোটাে গণ্ডির মধ্যে বড়ো বেশি করে বদ্ধ করেছে। এখন সে বাইরে থেকে সেবা ও সঙ্গ পাবার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকে, চিঠিপত্র ঠিকমত না পেলে উদবিগ্ন হয়, ভাবনাগুলো দেখতে দেখতে কালো হয়ে ওঠে । তাই দাদার ‘পরে কুমুর স্নেহ আজ যেন মাতৃস্নেহের মতো রূপ ধরেছে- তার অমন ধৈর্যগভীর আত্মসমাহিত দাদার মধ্যে কোথা থেকে যেন বালকের ভাব এল, এত আবদার, এত চাঞ্চল্য, এত জেদ । আর সেইসঙ্গে এমন গভীর বিষাদ আর উৎকণ্ঠ । কিন্তু কুমু এসে দেখলে তার দাদার সেই আবেশটাি কেটে গিয়েছে। তার চোখে যে আগুন জ্বলেছে। সে যেন মহাদেবের তৃতীয় নেত্রের আগুনের মতো, নিজের কোনো বেদনার জন্যে নয়— সে তার দৃষ্টির সামনে বিশ্বের কোনো পাপকে দেখতে পাচ্ছে, তাকে দগ্ধ করা চাই। কুমুর কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে সামনের দেয়ালে অনিমেষ দৃষ্টি রেখে বিপ্রদাস চুপ করে বসে রইল। কুমু আর খানিক বাদে আবার জিজ্ঞাসা করলে, “দাদা, কী হয়েছে বলে ।” বিপ্রদাস যেন এক দূর লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি রেখে বললে, “দুঃখ এড়াবার জন্যে চেষ্টা করলে দুঃখ পেয়ে বসে । ওকে জোরের সঙ্গে মানতে হবে ।” “তুমি উপদেশ দাও, আমি মানতে পারব দাদা ।” “আমি দেখতে পাচ্ছি, মেয়েদের যে অপমান, সে আছে সমস্ত সমাজের ভিতরে, সে DSDDD SL DD SS কুমু ভালো করে তার দাদার কথার মানে বুঝতে পারলে না। বিপ্রদাস বললে, “ব্যথাটাকে আমারই আপনার মনে করে এতদিন কষ্ট পাচ্ছিলুম, আজ বুঝতে পারছি, এর সঙ্গে লড়াই করতে হবে, সকলের হয়ে ।” বিপ্রদাসের ফ্যাকাশে গৌরবর্ণ মুখের উপর লাল আভা এল। ওর কোলের উপর রেশমের কাজ-করা একটা চৌকো বালিশ ছিল সেটাকে ঠেলে হঠাৎ সরিয়ে ফেলে দিলে। বিছানা থেকে উঠে পাশের হাতাওয়ালা চৌকির উপর বসতে যাচ্ছিল, কুমুওর হাত চেপে ধরে বললে, “শান্ত হও দাদা, উঠো না, তোমার অসুখ বাড়বে।” বলে একটু জোর করেই পিঠের দিকের উচু-করা বালিশের উপর বিপ্ৰদাসকে হেলিয়ে শুইয়ে দিলে । مه“ বিপ্রদাস গায়ের কাপড়টাকে মুঠো দিয়ে চেপে ধরে বললে, “সহ্য করা ছাড়া মেয়েদের অন্য কোনো রাস্তা একেবারেই নেই বলেই তাদের উপর কেবলই মাের এসে পড়ছে। বলবার দিন এসেছে যে সহ্য করব না। কুমু, এখানেই তোর ঘর মনে করে থাকতে পারবি ? ও বাড়িতে তোর যাওয়া চলবে না ।” কালুর কাছ থেকে বিপ্রদাস আজ অনেক কথা শুনেছে। শ্যামাসুন্দরীর সঙ্গে মধুসূদনের যে সম্বন্ধ ঘটেছে তার মধ্যে অপ্রকাশ্যতা আর ছিল না। ওরা দুই পক্ষই অকুষ্ঠিত লোকে ওদেরকে অপরাধী মনে করছে মনে করেই ওরা স্পর্ধিত হয়ে উঠেছে। এই সম্বন্ধটার মধ্যে সূক্ষ্ম কাজ কিছুই ছিল না বলেই পরস্পরকে এবং লোকমতকে বঁচিয়ে চলা ওদের পক্ষে ছিল অনাবশ্যক। শোনা গেছে শ্যামাসুন্দরীকে মধুসূদন কখনো কখনো মেরেওছে, শ্যামা যখন