পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 8○総 ঘুরে ফিরে আটকা পড়ি । তোমরা অনেক জান তাতেই তোমাদের মন ছাড়া পায়, আমরা অনেক মানি তাতেই আমাদের জীবনের শূন্য ভরে । তুমি যখন বুঝিয়ে দাও তখন বুঝতে পারি হয়তো আমার ভুল আছে। কিন্তু ভুল বুঝতে পারা, আর ভুল ছাড়তে পারা কি একই ? লতার আঁকড়ির মতো আমাদের মমত্ব সব কিছুকেই জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে, সেটা ভালোই হােক আর মন্দই হােক, তার পরে আর তাকে ছাড়তে পারি। নে ৷” বিপ্রদাস বললে, “সেইজন্যেই তো সংসারে কাপুরুষের পূজার পূজারিনীর অভাব হয় না। তারা জানিবার বেলা অপবিত্ৰকে অপবিত্র বলেই জানে, কিন্তু মানবার বেলায় তাকে পবিত্রের মতো করেই कान् ।।” w কুমু বললে, “কী করব দাদা, সংসারকে দুই হাতে জড়িয়ে নিতে হবে বলেই আমাদের সৃষ্টি । তাই আমরা গাছকেও আঁকড়ে ধরি, শুকনো কুটােকেও । গুরুকেও মানতে আমাদের যতক্ষণ লাগে, ভণ্ডকে মানতেও ততক্ষণ । জাল যে আমাদের নিজের ভিতরেই। দুঃখ থেকে আমাদেরকে বাচাবে কে ? সেইজন্যেই ভাবি দুঃখ যদি পেতেই হয়, তাকে মেনে নিয়েও তাকে ছাড়িয়ে ওঠবার উপায় করতে হবে । তাই তো মেয়েরা এত করে ধর্মকে আশ্রয় করে থাকে ৷” বিপ্রদাস কিছুই বললে না, চুপ করে বসে রইল। s সেই ওর চুপ করে বসে থাকাটাও কুমুকে কষ্ট দিলে। কুমু জানে কথা বলার চেয়েও এর ভার অনেক বেশি । ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মোতির মা কুমুকে জিজ্ঞাসা করলে, “কী ঠিক করলে বউরানী ?” কুমু বললে, “যেতে পারব না। তা ছাড়া, আমাকে তো ফিরে যাবার অনুমতি দেন নি।” মোতির মা মনে মনে কিছু বিরক্তই হল। শ্বশুরবাড়ির প্রতি ওর শ্রদ্ধা যে বেশি তা নয়, তবে শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে দীর্ঘকালের মমত্ববোধ ওর হৃদয়কে অধিকার করে আছে। সেখানকার কোনো বউ যে তাকে লঙ্ঘন করবে। এটা তার কিছুতেই ভালো লাগল না। কুমুকে যা বললে তার ভাবটা এই পুরুষমানুষের প্রকৃতিতে দরদ কম আর তার অসংযম বেশি, গোড়া থেকেই এটা তো ধরা কথা । সৃষ্টি তো আমাদের হাতে নেই, যা পেয়েছি তাকে নিয়েই ব্যবহার করতে হবে । ‘ওরা ঐরকমই বলে মনটাকে তৈরি করে নিয়ে যেমন করে হােক সংসারটাকে চালানোই চাই । কেননা সংসারটাই মেয়েদের । স্বামী ভালোই হােক মন্দই হােক, সংসারটাকে স্বীকার করে নিতেই হবে । তা যদি ৷ একেবারে অসম্ভব হয় তা হলে মরণ ছাড়া আর গতিই নেই। কুমু হেসে বললে, “না হয় তাই হল । মরণের অপরাধ কী ?” মৃেতির মা উদবিগ্ন হয়ে বলে উঠল, “অমন কথা বোলো না।” কুমু জানে না, অল্পদিন হল ওদেরই পাড়াতে একটি সতেরো বছরের বউ কার্বলিক অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল । তার এম. এ. পাস-করা স্বামী- গবমেন্ট আপিসে বড়ো চাকরি করে । স্ত্রী খোপায় গোজবার একটা রুপের চিরুনি হারিয়ে ফেলেছে, মা'র কাছ থেকে এই নালিশ শুনে লোকটা তাকে লাথি মেরেছিল । মোতির মা'র সেই কথা মনে পড়ে গায়ে কাটা দিলে । মুচুকুন্ঠনের প্রবেশ। কুমু খুশি হয়ে উঠল। বললে, জনতুন ঠাকুরপাের আসতে বেশি। शद ना |” নবীন হেসে বললে, “ন্যায়শাস্ত্রে বউরানীর দখল আছে, আগে দেখেছেন শ্ৰীমতী ধোয়াকে, তার থেকে শ্ৰীমান আগুনের আবির্ভাব হিসেব করতে শক্ত ঠেকে নি ।” মোতির মা বললে, “বউরানী, তুমিই ওকে নাই দিয়ে বাড়িয়ে তুলেছি। ও বুঝে নিয়েছে। ওকে দেখলে তুমি খুশি হও, সেই দেমাকে-” “আমাকে দেখলেও খুশি হতে পারেন যিনি, তার কি কম ক্ষমতা ? যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনিও নিজের হাতের কাজ দেখে অনুতাপ করেন, আর যিনি আমার পাণিগ্রহণ করেছেন তঁর মনের ভাব দেব ন জনন্তি কুতো মনুষ্যাঃ !”