পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 SR রবীন্দ্র-রচনাবলী মিনিটের জন্যে। তোমার দাদা খুশি হবেন, কোনো ক্ষতি হবে না তার ” “আচ্ছা, আগে তুমি খেয়ে নাও, তার পরে হবে।” খাওয়া হয়ে গেলে পর কুমু নবীনকে বিপ্রদাসের ঘরে নিয়ে এল। দেখলে দাদা তখনো ঘুমোয় নি। ঘর প্রায় অন্ধকার, আলোর শিখা স্নান । খোলা জানলা দিয়ে তারা দেখা যায় ; থেকে থেকে হু হু করে বইছে দক্ষিণের হাওয়া ; ঘরের পর্দা, বিছানার ঝালর, আলনায় ঝোলানো বিপ্রদাসের কাপড় নানারকম ছায়া বিস্তার করে কেঁপে কেঁপে উঠছে ; মেঝের উপর খবরের কাগজের একটা পাতা যখন-তখন এলোমেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। আধ-শোওয়া অবস্থায় বিপ্ৰদাস স্থির হয়ে বসে । এগোতে নবীনের পা সরে না । প্রদোষের ছায়া আর রোগের শীর্ণতা বিপ্ৰদাসকে একটা আবরণ দিয়েছে, মনে হচ্ছে ও যেন সংসার থেকে অনেক দূর, যেন অন্য লোকে । মনে হল ওর মতো এমনতরো একলা মানুষ আর জগতে নেই । নবীন এসে বিপ্ৰদাসের পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, “বিশ্রামে ব্যাঘাত করতে চাই নে। একটি কথা বলে যাব । সময় হয়েছে, এইবার বউরানী ঘরে ফিরে আসবেন বলে আমরা চেয়ে আছি।” বিপ্ৰদাস কোনো উত্তর করলে না, স্থির হয়ে বসে রইল । খানিক পরে নবীন বললে, “আপনার অনুমতি পেলেই ওঁকে নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করি।” ইতিমধ্যে কুমু ধীরে ধীরে দাদার পায়ের কাছে এসে বসেছে। বিপ্রদাস তার মুখের উপায় দৃষ্টি রেখে বললে, “মনে যদি করিস তোর যাবার সময় হয়েছে তা হলে যা কুমু।” কুমু বললে, “না দাদা, যাব না।” বলে বিপ্রদাসের হাঁটুর উপর উপুড় হয়ে পড়ল । ঘর স্তব্ধ, কেবল থেকে থেকে দমকা বাতাসে একটা শিথিল জানলা খড়, খড় করছে, আর বাইরে বাগানে গাছের পাতাগুলো মমরিয়ে উঠছে। কুমু একটু পরে বিছানা থেকে উঠেই নবীনকে বললে, “চলো আর দেরি নয়। দাদা, তুমি ঘুমোও।” মোতির মা বাড়িতে ফিরে এসে বললে, “এতটা কিন্তু ভালো না ।” “অর্থাৎ চোখে খোচা দেওয়াটা যেমনি হােক-না, চোখটা রাঙা হয়ে ওঠা একেবারেই ভালো নয় ।” “না গো না, ওটা ওঁদের দেমাক । সংসারে ওঁদের যোগ্য কিছুই মেলে না, ওঁরা সবার উপরে।” “মেজেবিউ, এতবড়ো দেমাক সবাইকে সাজে না, কিন্তু ওঁদের কথা আলাদা ।” “আত্মীয়স্বজন বললেই আত্মীয়স্বজন হয় না। ওঁরা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আর-এক শ্রেণীর মানুষ । সম্পর্ক ধরে ওঁদের সঙ্গে ব্যবহার করতে আমার সংকোচ হয় ।” “যিনি যতবড়ো লোকই হােন-না কেন, তবু সম্পর্কের জোর আছে এটা মনে রেখো ।” নবীন বুঝতে পারলে এই আলোচনার মধ্যে কুমুর পরে মোতির মা'র একটুখানি ঈর্ষার ঝাজও আছে। তা ছাড়া এটাও সত্যি, পারিবারিক বাধনটার দাম মেয়েদের কাছে খুবই বেশি। তাই নবীন এ নিয়ে বৃথা তর্ক না করে বললে, “আর কিছুদিন দেখাই যাক-না। দাদার আগ্রহটাও একটু বেড়ে উঠুক, তাতে ক্ষতি হবে না।” ○ ○ মধুসূদনের সংসারে তার স্থানটা পাকা হয়েছে বলেই শ্যামাসুন্দরী প্রত্যাশা করতে পারত, কিন্তু সে কথা অনুভব করতে পারছে না। বাড়ির চাকরিবাকিরদের পরে ওর কর্তৃত্বের দাবি জন্মেছে বলে প্রথমটা ও মনে করেছিল, কিন্তু পদে পদে বুঝতে পারছে যে তারা ওকে মনে মনে প্রভুপদে বসাতে রাজি নয় । ওকে সাহস করে প্রকাশ্যে অবজ্ঞা দেখাতে পারলে তারা যেন বঁাচে এমনি অবস্থা । সেইজন্যেই শ্যামা তাদেরকে যখন-তখন অনাবশ্যক ভৎসনা ও অকারণে ফরমাশ করে কেবলই তাদের দোষত্রুটি ধরে । , খিটু খিটু করে। বাপ মা তুলে গাল দেয়। কিছুদিন পূর্বে এই বাড়িতেই শ্যামা নগণ্য ছিল, সেই