পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 88尔 কালুর বুকে ব্যথা বাজল। সে বুঝলে এটা অসুস্থ মানুষের কথা, বিপ্রদাস তো এরকম হালছাড়া প্রকৃতির লোক নয়। পরিণামটাকে ঠেকাবার জন্যে বিপ্রদাস এতদিন নানারকম প্ল্যান করছিল। তার বিশ্বাস ছিল কাটিয়ে উঠবে। আজ ভাবতেও পারে না- বিশ্বাস করবারও জোর নেই। কালু স্নিগ্ধদৃষ্টিতে বিপ্রদাসের মুখের দিকে চেয়ে বললে, “তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না ভাই, যা করবার আমিই করব । যাই একবার দালাল-মহলে ঘুরে আসি গে।” পরদিন বিপ্রদাসের কাছে এক ইংরেজি চিঠি এল- মধুসূদনের লেখা। ভাষাটা ওকালতি ছাদের- হয়তো বা অ্যাটর্নিকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। নিশ্চিত করে জানতে চায় কুমু ওদের ওখানে ফিরে আসবে কি না, তার পরে যথাকর্তব্য করা হবে । বিপ্রদাস কুমুকে জিজ্ঞাসা করলে, “কুমু, ভালো করে সব ভেবে দেখেছিস ?” 骨 কুমু বললে, “ভাবনা সম্পূর্ণ শেষ করে দিয়েছি, তাই আমার মন আজ খুব নিশ্চিন্ত। ঠিক মনে হচ্ছে যেমন এখানে ছিলুম তেমনি আছি- মাঝে যা-কিছু ঘটেছে সমস্ত স্বপ্ন ।” “যদি তোকে জোর করে নিয়ে যাবার চেষ্টা হয়, তুই জোর করে সামলাতে পারবি ?” “তোমার উপর উৎপাত যদি না হয় তো খুব পারব।” “এইজন্যে জিজ্ঞাসা করছি যে, যদি শেষকালে ফিরে যেতেই হয় তা হলে যত দেরি করে যাবি দুঃপেটা বিস্ত্রী হয়ে উঠবে। এদের সঙ্গে সন্ধ্যসূত্র তাের ফােক কোথাও কিছুমাত্র জড়িয়েছে i «وp “কিছুমাত্র না। কেবল আমি নবীনকে, মোতির মাকে, হাবলুকে ভালোবাসি। কিন্তু তারা ঠিক যেন অন্য বাড়ির লোক ৷” “দেখ, কুমু, ওরা উৎপাত করবে। সমাজের জোরে, আইনের জোরে উৎপাত করবার ক্ষমতা ওদের আছে । সেইজন্যেই সেটাকে অগ্রাহ্য করা চাই । করতে গেলেই লজ্জা সংকোচ ভয় সমস্ত বিসর্জন মাথা তুলে তোর ঠিক থাকা চাই।” “দাদা, তাতে তোমার অনিষ্ট, তোমার অশান্তি হবে না ?” “অনিষ্ট অশান্তি কাকে তুই বলিস কুমু ? তুই যদি অসম্মানের মধ্যে ডুবে থাকিস তার চেয়ে অনিষ্ট আমার আর কী হতে পারে ? যদি জানি যে, যে ঘরে তুই আছিস সে তোর ঘর হয়ে উঠল না, তোর উপর যার একান্ত অধিকার সে তোর একান্ত পর, তবে আমার পক্ষে তার চেয়ে অশান্তি ভাবতে পারি নে। বাবা তোকে খুব ভালোবাসতেন, কিন্তু তখনকার দিনে কর্তারা থাকতেন দূরে দূরে । তোর পক্ষে পড়াশুনোর দরকার আছে তা তিনি মনেই করতেন না। আমিই নিজে গোড়া থেকে তোকে শিখিয়েছি, তোকে মানুষ করে তুলেছি। তোর বাপ-মা'র চেয়ে আমি কোনো অংশে কম না। সেই মানুষ করে তোলার দায়িত্ব যে কী আজ তা বুঝতে পারছি। তুই যদি অন্য মেয়ের মতোহতিসমতা হলে কোথাও তোর ঠেকত না । আজ যেখানে তোর স্বাতন্ত্র্যকে কেউ বুঝবে না, সম্মান করবে না, সেখানে যে তোর নরক । আমি কোন প্রাণে তােকে সেখানে নির্বাসিত করে থাকব ? যদি আমার ছােটাে ভাই হাতিসতা হলে যেমন করে থাকতিসি তেমনি করেই চিরদিন থাক-না। আমার কাছে।” দাদার বুকের কাছে খাটের প্রান্তে মাথা রেখে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কুমু বললে, “কিন্তু আমি তোমাদের তো ভার হয়ে থাকব না ? ঠিক বলছ ?” কুমুর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বিপ্রদাস বললে, “ভার কেন হবি বোন ? তোকে খুব খাটিয়ে নেব । আমার সব কাজ দেব তোর হাতে । কোনো প্ৰাইভেট সেক্রেটারি এমন করে কাজ করতে পারবে না । আমাকে তোর বাজনা শোনাতে হবে, আমার ঘোড়া তোর জিম্মেয় থাকবে । তা ছাড়া জানিস আমি শেখাতে ভালোবাসি। তোর মতো ছাত্রী পাব কোথায় বল ? এক কাজ করা যাবে, । অনেক দিন থেকে পারসি পড়বার শখ আমার আছে। একলা পড়তে ভালো লাগে না । তোকে নিয়ে । পড়ব, তুই নিশ্চয় আমার চেয়ে এগিয়ে যাবি, আমি একটুও হিংসে করব না দেখিস ।”