পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 − রবীন্দ্র-রচনাবলী ঢুকতুম না। দাদা, এ সংসারে তুমি আমার আছ বলেই তবে এ কথা বুঝতে পেরেছি।” এই বলেই কুমু চৌকি থেকে নেবে দাদার পায়ের উপর মাথা রেখে পড়ে রইল । রাত বেড়ে চলল, বিপ্ৰদাস জানালার বাইরে অনিমেষ দৃষ্টি মেলে ভাবতে লাগল। (፩br পরদিন ভোরে সি প্রদাস কুমুকে ডেকে পাঠালে। কুমু এসে দেখে বিপ্রদাস বিছানায় বসে, একটি এসরাজ আছে কোলের উপর, আর একটি পাশে শোওয়ানো । কুমুকে বললে, “নে যন্ত্রটা, আমরা দুজনে মিলে বাজাই ।” তখনো অল্প অল্প অন্ধকার, সমস্ত রাত্রির পরে বাতাস একটু ঠাণ্ডা হয়ে অশথপাতার মধ্যে ঝির ঝির করছে, কাকগুলো ডাকতে শুরু করেছে। দুজনে ভৈরো রাগিণীতে আলাপ শুরু করলে, গভীর শান্ত সকরুণ ; সতীবিরহ যখন আচঞ্চল হয়ে এসেছে, মহাদেবের সেইদিনকার প্রভাতের ধ্যানের মতো। বাজাতে বাজাতে পুষ্পিত কৃষ্ণচুড়ার ডালের ভিতর দিয়ে অরুণ-আভা উজ্জ্বলতর হয়ে উঠল, সূর্য দেখা দিল বাগানের পাচিলের উপরে। চাকররা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গেল। ঘর সাফ করা হল না। রোদুর ঘরের মধ্যে এল, দরোয়ান আস্তে আস্তে এসে খবরের কাগজ টিপাইয়ের উপর রেখে দিয়ে নিঃশব্দপদে চলে গেল । অবশেষে বাজনা বন্ধ করে বিপ্রদাস বললে, “কুমু, তুই মনে করিস আমার কোনো ধর্ম নেই। আমার ধর্মকে কথায় বলতে গেলে ফুরিয়ে যায়। তাই বলি নে । গানের সুরে তার রূপ দেখি, তার মধ্যে গভীর দুঃখ গভীর আনন্দ এক হয়ে মিলে গেছে ; তাকে নাম দিতে পারি নে। তুই আজ চলে যাচ্ছিস কুমু, আর হয়তো দেখা হবে না, আজ সকালে তোকে সেই সকল বেসুরের সকল অমিলের পরপারে এগিয়ে দিতে এলুম। শকুন্তলা পড়েছিস- দুষ্মস্তের ঘরে যখন শকুন্তলা যাত্রা করে বেরিয়েছিল, কথা কিছুদূর পর্যন্ত তাকে পৌঁছিয়ে দিলেন । যে লোকে তাকে উত্তীর্ণ করতে তিনি বেরিয়েছিলেন, তার মাঝখানে ছিল দুঃখ-অপমান । কিন্তু সেইখানেই থামল না, তাও পেরিয়ে শকুন্তলা পৌঁচেছিল আচঞ্চল শান্তিতে। আজ সকালের ভৈরোর মধ্যে সেই শান্তির সুর, আমার সমস্ত অন্তঃকরণের আশীর্বাদ তোকে সেই নির্মল পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিক ; সেই পরিপূর্ণতা তোর অন্তরে তোর বাহিরে, তোর সব দুঃখ তোর সব অপমানকে প্লাবিত করুক।” কুমু কোনো কথা বললে না। বিপ্রদাসের পায়ে মাথা রেখে প্ৰণাম করলে। খানিকক্ষণ জানলার বাইরের আলোর দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে রইল। তার পরে বললে, “দাদা, তোমার চা-রুটি আমি তৈরি করে নিয়ে আসি গে৷ ” মধুসূদন আজ দৈবজ্ঞকে ডাকিয়ে শুভযাত্রার লগ্ন ঠিক করে রেখেছিল। সকালে দশটার কিছু পরে । ঠিক সময়ে জরির-কাজ-করা লাল বানাতের ঘেরাটোপওয়ালা পালকি এল দরজায়, আসাসোটা নিয়ে লোকজন এল, সমারোহ করে কুমুকে নিয়ে গেল মির্জাপুরের প্রাসাদে । আজ সেখানে নহবত বাজছে, আর চলছে ব্ৰাহ্মণভোজন, ব্ৰাহ্মণবিদায়ের আয়োজন । মানিক এল বার্লির পেয়ালা হাতে বিপ্ৰদাসের ঘরে । আজ বিপ্ৰদাস বিছানায় নেই, জানলার সামনে চৌকি টেনে নিয়ে স্থির বসে আছে। বালি যখন এল কোনো খবরই নিলে না । চাকর ফিরে গেল । তখন ক্ষেমপিসি এলেন পথ্য নিয়ে, বিপ্ৰদাসের কাধে হাত দিয়ে বললেন, “বিপু, বেলা হয়ে গেছে, বাবা ।” বিপ্রদাস চৌকি থেকে ধীরে ধীরে উঠে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ক্ষেমপিসির ইচ্ছা ছিল কেমন ধুমধাম করে আদর করে ওরা কুমুকে নিয়ে গেল তার বিস্তারিত বর্ণনা করে গল্প করেন। কিন্তু বিপ্রদাসের গভীর নিস্তান্ধতা দেখে কোনো কথাই বলতে পারলেন না, মনে হল বিপ্ৰদাসের চোখের সামনে একটা অতলস্পর্শ শূন্যতা। বিপ্রদাস যখন বলে উঠল “পিসি, কালুকে পাঠিয়ে দাও।” তখন এই সামান্য কথাটাও অদৃষ্ট্রের একটা