পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা SVS পুরুষবন্ধুর চৌকির হাতার উপরে বসে সেই পাখার আঘাতে তাদের কৃত্রিম স্পর্ধার প্রতি কৃত্রিম তর্জন প্ৰকাশ করে থাকে । আপন দলের মেয়েদের সঙ্গে অমিতার ব্যবহার দেখে তার দলের পুরুষদের মনে ঈর্ষার উদয় হয়। নির্বিশেষ ভাবে মেয়েদের প্রতি অমিতার ঔদাসীন্য নেই, বিশেষ ভাবে কারও প্রতি আসক্তিও দেখা যায় না, অথচ সাধারণভাবে কোনোখানে মধুর রসেরও অভাব ঘটে না । এক কথায় বলতে গেলে মেয়েদের সম্বন্ধে ওর আগ্রহ নেই, উৎসাহ আছে। অমিত পাটিতেও যায়, তাসও খেলে, ইচ্ছে করেই বাজিতে হারে, যে রমণীর গলা বেসুরো তাকে দ্বিতীয়বার গাইতে পীড়াপীড়ি করে, কাউকে বদ-রঙের কাপড় পরতে দেখলে জিজ্ঞাসা করে কাপড়টা কোন দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। যে-কোনো আলাপিতার সঙ্গেই কথা বলে বিশেষ পক্ষপাতের সুর লাগায় ; অথচ সবাই জানে, ওর পক্ষপাতটা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ । যে মানুষ অনেক দেবতার পূজারি, আড়ালে সব দেবতাকেই সে সব দেবতার চেয়ে বড়ো বলে স্তব করে ; দেবতাদের বুঝতে বাকি থাকে না, অথচ খুশিও হন । কন্যার মাতাদের আশা কিছুতেই কমে না, কিন্তু কন্যারা বুঝে নিয়েছে, অমিত সোনার রঙের দিগন্তরেখা, ধরা দিয়েই আছে। তবু কিছুতেই ধরা দেবে না । মেয়েদের সম্বন্ধে ওর মন তর্কই করে, মীমাংসায় আসে না । সেইজন্যেই গম্যবিহীন আলাপের পথে ওর এত দুঃসাহস । তাই অতি সহজেই সকলের সঙ্গে ও ভাব করতে পারে, নিকটে দাহ্যবস্তু থাকলেও ওর তরফে আগ্নেয়তা নিরাপদে সুরক্ষিত । সেদিন পিকনিকে গঙ্গার ধারে যখন ও পারের ঘন কালো পুঞ্জীভূত স্তব্ধতার উপরে চাঁদ উঠল, ওর পাশে ছিল লিলি গাঙ্গুলি । তাকে ও মৃদুস্বরে বললে, “গঙ্গার ও পারে ঐ নতুন চাদ, আর এ পারে তুমি আর আমি, এমন সমাবেশটি অনন্তকালের মধ্যে কোনোদিনই আর হবে না ।” প্রথমটা লিলি গাঙ্গুলির মন এক মুহুর্তে ছলছলিয়ে উঠেছিল ; কিন্তু সে জানত, এ কথাটায় যতখানি সত্য সে কেবল ঐ বলার কায়দাঁটুকুর মধ্যেই। তার বেশি দাবি করতে গেলে বুদবুদের উপরকার বর্ণচ্ছটাকে দাবি করা হয় । তাই নিজেকে ক্ষণকালের ঘোর-লাগা থেকে ঠেলা দিয়ে লিলি হেসে উঠল, বললে, “আমিট, তুমি যা বললে সেটা এত বেশি সত্য যে, না বললেও চলত। এইমাত্র যে ব্যাঙটা টপ করে জলে লাফিয়ে পড়ল এটাও তো অনন্তকালের মধ্যে আর কোনোদিন ঘটবে না ।” । অমিত হেসে উঠে বললে, “তফাত আছে, লিলি, একেবারে অসীম তফাত । আজকের সন্ধ্যাবেলায় ঐ ব্যাঙের লাফানোটা একটা খাপছাড়া ছেড়া জিনিস। কিন্তু তোমাতে আমাতে চান্দেতে, গঙ্গার ধারায়, আকাশের তারায়, একটা সম্পূর্ণ ঐকতানিক সৃষ্টি- বেটােফেনের চন্দ্ৰলোক-গীতিকা। আমার মনে হয় যেন বিশ্বকর্মর কারখানায় একটা পাগলা স্বগীয় স্যাকরা আছে ; সে যেমনি একটি নিখুঁত সুগোল সোনার চক্ৰে নীলার সঙ্গে হীরে এবং হীরের সঙ্গে পান্না লাগিয়ে এক প্রহরের আঙটি সম্পূর্ণ করলে অমনি দিলে সেটা সমুদ্রের জলে ফেলে, আর তাকে খুঁজে পাবে না কেউ।” “ভালোই হল, তোমার ভাবনা রইল না, অমিট, বিশ্বকর্মর স্যাকরার বিল তোমাকে শুধতে হবে ' “কিন্তু লিলি, কোটি কোটি যুগের পর যদি দৈবাৎ তোমাতে আমাতে মঙ্গলগ্রহের লাল অরণ্যের ছায়ায় তার কোনো-একটা হাজার-ক্রোশী খালের ধারে মুখোমুখি দেখা হয়, আর যদি শকুন্তলার সেই জেলেটা বোয়াল মাছের পেট চিরে আজকের এই অপরূপ সোনার মুহুর্তটিকে আমাদের সামনে এনে ধরে, চমকে উঠে মুখ-চাওয়া-চাউয়ি করব, তার পরে কী হবে ভেবে দেখো ।” লিলি অমিতকে পাখার বাড়ি তাড়না করে বললে, “তার পরে সোনার মুহুর্তটি অন্যমনে খসে পড়বে সমুদ্রের জলে। আর তাকে পাওয়া যাবে না। পাগলা স্যাকরার গড়া এমন তোমার কত মুহূর্ত খসে পড়ে গেছে, ভুলে গেছ বলে তার হিসেব নেই।” এই বলে লিলি তাড়াতাড়ি উঠে তার সখীদের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিলে । অনেক ঘটনার মধ্যে এই একটা ঘটনার নমুনা দেওয়া গেল । অমিতার বোন সিসি-লিসিরা ওকে বলে, “আমি, তুমি বিয়ে কর না কেন ?”