পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা 8VN) দিয়ে। শিকল নেই। যার সে বাধে আফিম খাইয়ে, অর্থাৎ মায়া দিয়ে শিকলওয়ালা বাধে বটে, কিন্তু ভোলায় না ; আফিমওয়ালী বাধেও বটে, ভোলায়ও । মেয়েদের কীেটো আফিমে ভরা, প্রকৃতি-শয়তানী তার জোগান দেয় ।” একদিন ওদের বালিগঞ্জের এক সাহিত্যসভায় রবি ঠাকুরের কবিতা ছিল আলোচনার বিষয় । অমিতার জীবনে এই সে প্রথম সভাপতি হতে রাজি হয়েছিল ; গিয়েছিল মনে মনে যুদ্ধসাজ প’রে । একজন সেকেলেগোছের অতি ভালোমানুষ ছিল বক্তা। রবি ঠাকুরের কবিতা যে কবিতাই এইটে প্রমাণ করাই তার উদ্দেশ্য। দুই-একজন কলেজের অধ্যাপক ছাড়া অধিকাংশ সভ্যই স্বীকার করলে, প্রমাণটা একরকম সন্তোষজনক । সভাপতি উঠে বললে, “কবিমাত্রের উচিত। পাচ-বছর মেয়াদে কবিত্ব করা, পঁচিশ থেকে ত্রিশ পর্যন্ত। এ কথা বলব না যে, পরবতীদের কােছ থাকে আরো ভালাে কিছু চাই, বলব। অন্য কিছু চাই। ফজলি আমি ফুরোলে বলব না, ‘আনো ফজলিতর আম ।’ বলব, নতুন বাজার থেকে বড়ো দেখে আতা নিয়ে এসো তো হে।” ডাবনারকেলের মেয়াদ অল্প, সে রসের মেয়াদ ; বুনো নারকেলের মেয়াদ বেশি, সে শাসের মেয়াদ । কবিরা হল ক্ষণজীবী, ফিলজফরের বয়সের গাছপাথর নেই।- রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড়ো নালিশ এই যে, বুড়ো ওঅর্ডসওঅর্থের নকল করে ভদ্রলোক অতি অন্যায়৷রকম বেঁচে আছে। যম বাতি নিবিয়ে দেবার জন্যে থেকে থেকে ফরাশ পাঠায়, তবু লোকটা দাড়িয়ে দাঁড়িয়েও চৌকির হাতা আঁকড়িয়ে থাকে। ও যদি মানে মানে নিজেই সরে না পড়ে, আমাদের কর্তব্য ওর সভা ছেড়ে দল বেঁধে উঠে আসা। পরবতী যিনি আসবেন তিনিও তাল ঠুকেই গর্জাতে গর্জাতে আসবেন যে, তার রাজত্বের অবসান নেই। অমরাবতী রাধা থাকবে মর্তে র্তারই দরজায়। কিছুকাল ভক্তরা দেবে মাল্যচন্দন, খাওয়াবে পেট ভরিয়ে, সাষ্টাঙ্গে প্ৰণিপাত করবে, তার পরে আসবে র্তাকে বলি দেবার পূণ্য দিন- ভক্তিবন্ধন থেকে ভক্তদের পরিত্রাণের শুভ লগ্ন। আফ্রিকায় চতুষ্পদ দেবতার পুজোর প্রণালী এইরকমই। দ্বিপদী ত্রিপদী চতুষ্পদী চতুর্দশপদী দেবতাদের পুজোও এই নিয়মে। পূজা জিনিসটাকে একঘেয়ে করে তোলার মতো অপবিত্ৰ অধাৰ্মিকতা আর কিছু হতে পারে না ।- ভালো লাগার এভোলুশন আছে। পাঁচ বছর পূর্বেকার ভালো-লাগা পাঁচ বছর পরেও যদি একই জায়গায় খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে, বেচারা জানতে পারে নি যে সে মরে গেছে। একটু ঠেলা মারলেই তার নিজের কাছে প্রমাণ হবে যে, সেন্টিমেন্টাল আগ্ৰীয়েরা তার অন্ত্যেষ্টি-সৎকার করতে বিলম্ব করেছিল, বোধ করি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীকে চিরকাল ফাকি দেবার মতলবে । রবি ঠাকুরের দলের এই অবৈধ যড়যন্ত্র আমি পাব্লিকের কাছে প্ৰকাশ করব বলে প্ৰতিজ্ঞা করেছি।” আমাদের মণিভূষণ চশমার ঝলক লাগিয়ে প্রশ্ন করলে, “সাহিত্য থেকে লয়ালটি উঠিয়ে দিতে be p” “একেবারেই। এখন থেকে কবি-প্রেসিডেন্টের দ্রুতনিঃশেষিত যুগ। রবি ঠাকুর সম্বন্ধে আমার দ্বিতীয় বক্তব্য এই যে, তার রচনারেখা তারই হাতের অক্ষরের মতো- গোল বা তরঙ্গরেখা, গোলাপ বা নারীর মুখ বা চাদের ধরনে। ওটা প্রিমিটিভ ; প্রকৃতির হাতের অক্ষরের মকশো-করা। নতুন প্রেসিডেন্টের কাছে চাই কড়া লাইনের, খাড়া লাইনের রচনা- তীরের মতো, বর্শার ফলার মতো, কঁাটার মতো । ফুলের মতো নয়, বিদ্যুতের রেখার মতো। নূর্যোলজিয়ার ব্যথার মতো । খোচাওয়ালা কোণাওয়ালা গথিক গির্জের ছাদে, মন্দিরের মণ্ডপের ছাদে নয় । এমন-কি, যদি চটকল পাটকল অথবা সেক্রেটারিয়েট বিন্ডিঙের আদলে হয়, ক্ষতি নেই। -- এখন থেকে ফেলে দাও মনভোলাবার ছলাকলা ছন্দোবন্ধ, মন কেড়ে নিতে হবে, যেমন করে রাবণ সীতাকে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল । মন যদি কঁদতে কঁদতে আপত্তি করতে করতে যায়। তবুও তাকে যেতেই হবে- অতিবৃদ্ধ জটায়ুটা বারণ করতে আসবে, তাই করতে গিয়েই তার হবে মরণ। তার পরে কিছুদিন যেতেই কিষ্কিন্ধ্যা জেগে উঠবে, কোন হনুমান হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে লঙ্কায় আগুন লাগিয়ে মনটাকে পূর্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসবার ব্যবস্থা করবে। তখন আবার হবে টেনিসনের সঙ্গে পুনর্মিলন, বায়রনের গলা জড়িয়ে করব অশুবর্ষণ ;