পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Գ8 द्रवैी-झन्नवी এমন কয়েক দিন যায়। সেদিন রবিবার। শোভনলাল তার খাতপত্র টেবিলের উপর সাজিয়ে একখানা বই নিয়ে পাতা ওলটাচ্ছে, মাঝে মাঝে নোট নিচ্ছে। তখন দুপুরবেলা, ঘরে কেউ নেই। ছুটির দিনের সুযোগ নিয়ে অবনীশ কোন-এক বাড়িতে যাচ্ছেন তার নাম করলেন না। বলে গেলেন, আজ আর চা “ খেতে আসবেন না । হঠাৎ এক সময় ভেজানো দরজা জোরে খুলে গেল । শোভনলালের বুকটা ধড়াস করে উঠল কেঁপে। লাবণ্য ঘরে ঢুকল। শোভন শশব্যস্ত হয়ে উঠে কী করবে ভেবে পেল না। লাবণ্য অগ্নিমূর্তি ধরে বললে, “আপনি কেন এ বাড়িতে আসেন ?” শোভনলাল চমকে উঠল, মুখে কোনো উত্তর এল না । “আপনি জানেন, এখানে আসা নিয়ে আপনার বাবা কী বলেছেন ? আমার অপমান ঘটাতে আপনার সংকোচ নেই ?” শোভনলাল চোখ নিচু করে বললে, “আমাকে মাপ করবেন, আমি এখনই যাচ্ছি।” এমন উত্তর পর্যন্ত দিলে না যে, লাবণ্যর পিতা তাকে স্বয়ং আমন্ত্রণ করে এনেছেন । সে তার খতাপত্র সমস্ত সংগ্রহ করে নিলে। হাত থর থর করে কঁপছে; বোবা একটা ব্যথা বুকের পাজারগুলোকে ঠেলা দিয়ে উঠতে চায়, রাস্তা পায় না। মাথা হেঁট করে বাড়ি থেকে সে চলে গেল। যাকে খুবই ভালোবাসা যেতে পারত। তাকে ভালোবাসবার অবসর যদি কোনো-একটা বাধায় ঠেকে ফসকে যায়, তখন সেটা না-ভালোবাসায় দাড়ায় না, সেটা দাড়ায় একটা অন্ধ বিদ্বেষে, ভালোবাসারই উলটাে পিঠে । একদিন শোভনলালকে বরদান করবে বলেই বুঝি লাবণ্য নিজের অগোচরেই অপেক্ষা করে বসে ছিল । শোভনলাল তেমন করে ডাক দিলে না। তার পরে যা-কিছু হল সবই গেল তার বিরুদ্ধে । সকলের চেয়ে বেশি আঘাত দিলে এই শেষকালটায় । লাবণ্য মনের ক্ষোভে বাপের প্রতি আবার নিজে থেকে ডেকে এনেছেন ওদের দুজনের মিলন ঘটাবার কামনায় । তাই এমন দারুণ ক্ৰোধ হল সেই নিরপরাধের উপরে। তার পর থেকে লাবণ্য ক্রমাগতই জেদ করে করে অবনীশের বিবাহ ঘটালো | অবনীশ তার সঞ্চিত টাকার প্রায় অর্ধাংশ তীর মেয়ের জন্যে স্বতন্ত্র করে রেখেছিলেন । তার বিবাহের পরে লাবণ্য বলে বসিল, সে তার পৈতৃক সম্পত্তি কিছুই নেবে না, স্বাধীন উপাৰ্জন করে চালাবে। অবনীশ মর্মাহত হয়ে বললেন, “আমি তো বিয়ে করতে চাই নি লাবণ্য, তুমিই তো জেদ করে বিয়ে দিইয়েছ। তবে কেন আজ আমাকে তুমি এমন করে ত্যাগ করছ।” লাবণ্য বললে, “আমাদের সম্বন্ধ কোনোকালে যাতে ক্ষুন্ন না হয়। সেইজন্যেই আমি এই সংকল্প করেছি। তুমি কিছু ভেবো না বাবা ! যে পথে আমি যথার্থ সুখী হব সেই পথে তোমার আশীর্বাদ চিরদিন রেখো ।” কাজ তার জুটে গেল। সুরমাকে পড়বার সম্পূর্ণ ভার তার উপরে। যতিকেও অনায়াসে পড়াতে পারত, কিন্তু মেয়ে-শিক্ষয়িত্রীর কাছে পড়বার অপমান স্বীকার করতে যতি কিছুতেই রাজি হল না। প্রতিদিনের বাধা কাজে জীবন একরকম চলে যাচ্ছিল। উদবুত্ত সময়টা ঠাসা ছিল ইংরেজি সাহিত্যে, প্রাচীন কাল থেকে আরম্ভ করে হালের বার্নার্ড শ'র আমল পর্যন্ত, এবং বিশেষভাবে গ্ৰীক ও রোমান যুগের ইতিহাসে, গ্রেট, গিবন ও গিলবার্ট মারের রচনায়। কোনো কোনো অবকাশে একটা চঞ্চল হাওয়া এসে মনের ভিতরটা যে একটু এলোমেলো করে যেত না তা বলতে পারি নে, কিন্তু হাওয়ার চেয়ে স্থূল ব্যাঘাত হঠাৎ ঢুকে পড়তে পারে ওর জীবনযাত্রার মধ্যে এমন প্রশস্তফাক ছিল না। এমন সময় ব্যাঘাত এসে পড়ল মোটরগাড়িতে চড়ে, পথের মাঝখানে, কোনো আওয়াজমাত্র না করে । হঠাৎ গ্ৰীস-রোমের বিরাট ইতিহাসটা হালকা হয়ে গেল ; আর সমস্ত কিছুকে সরিয়ে দিয়ে অত্যন্ত নিকটের একটা নিবিড় বর্তমান ওকে নাড়া দিয়ে বললে, “জাগো”। লাবণ্য এক মুহুর্তে জেগে উঠে এতদিন পরে আপনাকে বাস্তবরূপে দেখতে পেলে— জ্ঞানের মধ্যে নয়, বেদনার মধ্যে।