পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা 848 দেখুন-না, কথাটা একই, অথচ এইবার আপনি একেবারেই চুপ।” । লাবণ্য হেসে বললে, “আপনি তো বেশিদিনের মানুষ না, খুবই নতুন, আরো নতুনের ঝোক আপনার মধ্যে আসে কোথা থেকে ।” “এর জবাবে খুব-একটা গভীর কথাই বলতে হল যা চায়ের টেবিলে বলা চলে না। আমার মধ্যে নতুন যেটা এসেছে সেটাই অনাদিকালের পুরোনো, ভোরবেলাকার আলোর মতোই সে পুরোনো, নতুন-ফোটা ভূইচাপা ফুলেরই মতো, চিরকালের জিনিস নতুন করে আবিষ্কার ।” কিছু না বলে। লাবণ্য হাসলে । অমিত বললে, “আপনার এবারকার এই হাসিটি পাহারাওয়ালার চোর-ধরা গোল। লণ্ঠনের হাসি । বুঝেছি, আপনি যে কবির ভক্ত তার বই থেকে আমার মুখের এ কথাটা আগেই পড়ে নিয়েছেন । দোহাই আপনার, আমাকে দাগি চোর ঠাওরাবেন না । এক-এক -সময়ে এমন অবস্থা আসে, মনের ভিতরটা শংকরাচার্য হয়ে ওঠে ; বলতে থাকে, আমিই লিখেছি কি আর কেউ লিখেছে। এই ভেদজ্ঞানটা মায়া । এই দেখুন-না, আজ সকালে বসে হঠাৎ খেয়াল গেল, আমার জানা সাহিত্যের ভিতর থেকে এমন একটা লাইন বের করি যেটা মনে হবে এইমাত্র স্বয়ং আমি লিখলুম, আর কোনো কবির লেখবার সাধ্যই ছিল না ।” লাবণ্য থাকতে পারলে না, প্রশ্ন করলে, “বের করতে পেরেছেন ?” “হা, পেরেছি ?” লাবণ্যর কৌতুহল আর বাধা মানল না, জিজ্ঞাসা করে ফেললে, “লাইনটা কী বলুন-না।” "For God's sake, hold your tongue v, and let me love” লাবণ্যর বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। অনেকক্ষণ পরে অমিত জিজ্ঞাসা করলে, “আপনি নিশ্চয় জানেন লাইনটা কার্য ।” লাবণ্য একটু মাথা বেঁকিয়ে ইশারায় জানিয়ে দিলে, হঁহা । অমিত বললে, “সেদিন আপনার টেবিলে ইংরেজ কবি ডনের বই আবিষ্কার করলুম, নইলে এ লাইন আমার মাথায় আসত না ।” “আবিষ্কার নয় তো কী। বইয়ের দোকানে বই চোখে পড়ে, আপনার টেবিলে বই প্ৰকাশ পায় । পাব্লিক লাইব্রেরির টেবিল দেখেছি, সেটা তো বইগুলিকে বহন করে ; আপনার টেবিল দেখলুম, সে যে বইগুলিকে বাসা দিয়েছে । সেদিন ডনের কবিতাকে প্ৰাণ দিয়ে দেখতে পেয়েছি। মনে হল, অন্য কবির দরজায় ঠেলা ঠেলি ভিড়, বড়োলোকের শ্রাদ্ধে কাঙালি-বিদায়ের মতো । ডনের কাব্যমহল নির্জন, ওখানে দুটি মানুষ পাশাপাশি বসবার জায়গািটুকু আছে। তাই অমন স্পষ্ট করে শুনতে পেলুম আমার সকালবেলাকার মনের কথাটি দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর । ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর ।” pl লাবণ্য বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “আপনি বাংলা কবিতা লেখেন নাকি ৷” “ভয় হচ্ছে, আজ থেকে লিখতে শুরু করব।-বা। নতুন অমিত রায় কী-যে কাণ্ড করে বসবে, পুরোনো অমিত রায়ের তা কিছু জানা নেই। হয়তো-বা। সে এখনই লড়াই করতে বেরোবে।” “লড়াই ? কার, সঙ্গে ।” “সেইটো ঠিক করতে পারছি নে। কেবলই মনে হচ্ছে, খুব মস্ত কিছু একটার জন্যে একথুনি চোখ বুজে প্ৰাণ দিয়ে ফেলা উচিত, তার পরে অনুতাপ করতে হয় রয়ে বসে করা যাবে।” লাবণ্য হেসে বললে, “প্ৰাণ যদি দিতেই হয় তাে সাবধানে দেবেন।” “সে কথা আমাকে বলা অনাবশ্যক । কমু্যন্যাল রায়টের মধ্যে আমি যেতে নারাজ। মুসলমান