পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8tro r রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বঁচিয়ে, ইংরেজ বঁচিয়ে চলব। যদি দেখি বুড়োসুড়ো গোছের মানুষ, অহিংস্ৰ মেজাজের ধাৰ্মিক চেহারা, শিঙে বাজিয়ে মোটর হাঁকিয়ে চলেছে, তার সামনে দাড়িয়ে পথ আটকিয়ে বলব ‘যুদ্ধং দেহি!— ঐ যে-লোক অজীর্ণ রোগ সারবার জন্যে হাসপাতালে না গিয়ে এমন পাহাড়ে আসে, খিদে বাড়াবার জন্যে নির্লজ্জ হয়ে হাওয়া খেতে বেরোয় ।” লাবণ্য হেসে বললে, “লোকটা তবু যদি অমান্য করে চলে যায় ?” “তখন আমি পিছন থেকে দু হাত আকাশে তুলে বলব, এবারকার মতো ক্ষমা করলুম, তুমি আমার ভ্ৰাতা, আমরা এক ভারতমাতার সন্তান - বুঝতে পারছেন, মন যখন খুব বড়ো হয়ে ওঠে তখন মানুষ যুদ্ধও করে, ক্ষমাও করে।” লাবণ্য হেসে বললে, “আপনি যখন যুদ্ধের প্রস্তাব করেছিলেন মনে ভয় হয়েছিল, কিন্তু ক্ষমার কথা যেরকম বোঝালেন তাতে আশ্বস্ত হলুম যে ভাবনা নেই।” অমিত বললে, “আমার একটা অনুরোধ রাখবেন ?” “কী বলুন ।” “আজ খিদে বাড়াবার জন্যে আর বেশি বেড়াবেন না।” “আচ্ছা, বেশ, তার পরে ?” “ঐ নীচে গাছতলায় যেখানে নানা রঙের ছাতলা পড়া পাথরটার নীচে দিয়ে একটুখানি জল বিস্তুরঝির করে বয়ে যাচ্ছে ঐখানে বসবেন আসুন ।” লাবণ্য হাতে-বাধা ঘড়িটার দিকে চেয়ে বললে, “কিন্তু সময় যে অল্প ।” “জীবনে সেইটেই তো শোচনীয় সমস্যা, লাবণ্যদেবী, সময় অল্প । মরুপথে সঙ্গে আছে আধ-মেশক মাত্র জল। যাতে সেটা উছলে উছলে শুকনো ধুলোয় মারা না যায় সেটা নিতান্তই করা চাই। সময় যাদের বিস্তর তাদেরই পাঙ্কচুয়াল হওয়া শোভা পায়। দেবতার হাতে সময় অসীম তাই ঠিক সময়টিতে সূর্য ওঠে, ঠিক সময়ে অস্ত যায়। আমাদের মেয়াদ অল্প, পাঙ্কচুয়াল হতে গিয়ে সময় নষ্ট করা আমাদের পক্ষে অমিতব্যয়িতা । অমরাবতীর কেউ যদি প্রশ্ন করে ‘ভবে এসে করলে কী তখন কোন লজ্জায় বলব, ‘ঘড়ির কাটার দিকে চোখ রেখে কাজ করতে করতে জীবনের যা-কিছু সকল সময়ের অতীত তার দিকে চোখ তোলবার সময় পাই নি।” তাই তো বলতে বাধ্য হলুম, চলুন। ঐ জায়গাটাতে ।” ওর যেটাতে আপত্তি নেই সেটাতে আর কারও যে আপত্তি থাকতে পারে অমিত সেই আশঙ্কটাকে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে কথাবার্তা কয়। সেইজন্যে তার প্রস্তাবে আপত্তি করা শক্ত। লাবণ্য বললে, “চলুন।” ঘনবনের ছায়া । সরু পথ নেমেছে নীচে একটা খাসিয়া গ্রামের দিকে । অর্ধপথে আর-এক পাশ দিয়ে ক্ষীণ ঝরনার ধারা এক জায়গায় লোকালয়ের পথটাকে অস্বীকার করে তার উপর দিয়ে নিজের অধিকার চিহ্নস্বরূপ নুড়ি বিছিয়ে স্বতন্ত্র পথ চালিয়ে গেছে। সেইখানে পাথরের উপরে দুজনে বসল। ঠিক সেই জায়গায় খাদটা গভীর হয়ে খানিকটা জল জমে আছে, যেন সবুজ পর্দার ছায়ায় একটি পর্দানশীন মেয়ে, বাইরে পা বাড়াতে তার ভয় । এখানকার নির্জনতার আবরণটাই লাবণ্যকে নিরাবরণের মতো লজ্জা দিতে লাগল। সামান্য যা তা একটা কিছু বলে এইটেকে ঢাকা দিতে ইচ্ছে করছে, কিছুতেই কোনো কথা মনে আসছে না, স্বপ্নে যেরকম কণ্ঠরোধ হয় সেই দশা । ভাষা- একটা সাধু, আর-একটা চলতি। কিন্তু এ ছাড়া আরো একটা ভাষা থাকা উচিত ছিল— সমাজের ভাষা নয়, ব্যবসায়ের ভাষা নয়, আড়ালের ভাষা, এইরকম জায়গার জন্য। পাখির গানের মতো, কবির কাব্যের মতো সেই ভাষা অনায়াসেই কণ্ঠ দিয়ে বেরোনো উচিত ছিল, যেমন করে কান্না বেরোয় । সেজন্যে মানুষকে বইয়ের দোকানে ছুটতে হয় সেটা বড়ো লজ্জা । প্রত্যেকবার হাসির জন্যে যদি ডেন্টিস্টের দোকানে দৌড়াদৌড়ি করতে হত তা হলে কী হত ভেবে দেখুন। সত্যি বলুন লাবণ্যদেবী, এখনই আপনার সুর করে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ?”