পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা 8br(፩ “আমারও ঐ রকমের একটা বেসরকারি নাম চাই তো । ভাবছি 'ব্ৰহ্মপুত্র' কেমন হয়। বন্যা হঠাৎ এল তারই কুল ভাসিয়ে দিয়ে।” “নামটা সর্বদা ডাকবার পক্ষে ওজনে ভারী ।” “ঠিক বলেছ। কুলি ডাকতে হবে ডাকবার জন্যে। তুমিই তা হলে নামটা দাও। সেটা হবে তোমারই সৃষ্টি।” “আচ্ছা, আমিও দেব তোমার নাম ছেটে । তোমাকে বলব মিতা ।” “চমৎকার ! পদাবলীতে ওরই একটি দোসর আছে- বঁধু । বন্যা, মনে ভাবছি, ঐ নামে নাহয় আমাকে সবার সামনেই ডাকলে, তাতে দোষ কী ।” “ভয় হয়, এক কানের ধন পাচ কানে পাছে সন্তা হয়ে যায় ।” সুকুম দিয়ে নয়। দুইয়ের কানে যেটা এক, পাচর কানে সেটা ভগ্নাংশ । বন্যা ।” মিতা ।” T “তোমার নামে যদি কবিতা লিখি তো কোন মিলটা লাগাব জান ?- অনন্যা !” “তাতে কী বোঝাবে ।” “বোঝাবে, তুমি যা তুমি তাই-ই, তুমি আর কিছুই নও।” “সেটা বিশেষ আশ্চর্যের কথা নয় ।” “বল কী, খুবই আশ্চর্যের কথা । দৈবাৎ এক-একজন মানুষকে দেখতে পাওয়া যায় যাকে দেখেই চমকে বলে উঠি, এ মানুষটি একেবারে নিজের মতো, পাচজনের মতো নয়। সেই কথাটি আমি কবিতায় বলব— হে মোর বন্যা, তুমি অনন্যা, আপন স্বরূপে আপনি ধন্যা ।” “নিশ্চয়ই লিখব। কার সাধ্য রোধে তার গতি ।” “এমন মরিয়া হয়ে উঠলে কেন ।” “কারণ বলি। কাল রাত্তির আড়াইটা পর্যন্ত, ঘুম না হলে যেমন এ-পাশ ও-পাশ করতে হয় তেমনি করেই, কেবলই অক্সফোর্ড বুক অফ ভর্সেস-এর এ-পাত ও-পাত উলটেছি। ভালোবাসার কবিতা খুঁজেই পেলুম না, আগে সেগুলো পায়ে পায়ে ঠেকত । স্পষ্টই বুঝতে পারছি, আমি লিখব বলেই সমস্ত পৃথিবী আজ অপেক্ষা করে আছে।” এই বলেই লাবণ্যর বা হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে চেপে ধরে বললে, “হাত জোড়া পড়ল, কলম ধরব কী দিয়ে। সব চেয়ে ভালো মিল হাতে হাতে মিল। এই-যে তোমার আঙুলগুলি আমার আঙুলে আঙুলে কথা কইছে, কোনো কবিই এমন সহজ করে কিছু লিখতে পারলে না।” “কিছুই তোমার সহজে পছন্দ হয় না, সেইজন্যে তোমাকে এত ভয় করি মিতা।” “কিন্তু আমার কথাটা বুঝে দেখো । রামচন্দ্ৰ সীতার সত্য যাচাই করতে চেয়েছিলেন বাইরের আগুনে ; তাতেই সীতাকে হারালেন । কবিতার সত্য যাচাই হয়। অগ্নিপরীক্ষায়, সে আগুন অস্তরের । যার মনে নেই সেই আগুন সে যাচাই করবে। কী দিয়ে। তাকে পাঁচজনের মুখের কথা মেনে নিতে হয়, অনেক সময়ই সেটা দুমুখের কথা। আমার মনে আজ আগুন জ্বলেছে, সেই আগুনের ভিতর দিয়ে আমার পুরোনো সব পড়া আবার পড়ে নিচ্ছি, কত অল্পই টিকল। সব হু হু শব্দে ছাই হয়ে যাচ্ছে। কবিদের হট্টগোলের মাঝখানে দাড়িয়ে আজ আমাকে বলতে হল, তোমরা অত চেচিয়ে কথা কোয়ো না, ঠিক কথাটি আস্তে বলো For God's sake, hold your tongue and let me love!" অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে রইল। তার পরে এক সময়ে লাবণ্যর হাতখানি তুলে ধরে অমিত