পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা 8tra নতুন সৃষ্টিকে সে বাধা দেয়। রক্ষার প্রতি সৃষ্টি নিষ্ঠুর, সৃষ্টির প্রতি রক্ষা বিয়। এমন কেন হল। এক জায়গায় এরা পরস্পরকে আঘাত করবেই। যেখানে খুব ক’রে মিল সেইখানেই মন্ত বিরুদ্ধতা । তাই ভাবছি, আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো যে পাওনা সে মিলন নয়, সে মুক্তি ।” এ কথাটা ভাবতে অমিতকে পীড়া দিলে, কিন্তু ওর মন এটাকে অস্বীকার করতে পারলে না । br লাবণ্য-তর্ক যোগমায়া বললেন, “মা লাবণ্য, তুমি ঠিক বুঝেছ ?” “ঠিক বুঝেছি মা ।” “অমিত ভারি চঞ্চল, সে কথা মানি । সেইজন্যেই ওকে এত মোহ করি । দেখো-না, ও কেমনতরো এলোমেলো । হাত থেকে সবই যেন পড়ে পড়ে যায় ।” লাবণ্য একটু হেসে বললে, “ওঁকে সবই যদি ধরে রাখতেই হত, হাত থেকে সবই যদি খসে খসে না পড়ত, তা হলেই ওঁর ঘটত বিপদ ।। ওঁর নিয়ম হচ্ছে, হয়। উনি পেয়েও পাবেন না, নয়। উনি পেয়েই হারাবেন । যেটা পাবেন সেটা যে আবার রাখতে হবে এটা ওঁর ধাতের সঙ্গে মেলে না ।” “সত্যি করে বলি বাছা, ওর ছেলেমানুষি আমার ভারি ভালো লাগে।” “সেটা হল মায়ের ধর্ম। ছেলেমানুষিতে দায় যতী-কিছু সব মায়ের । আর ছেলের যত-কিছু সব খেলা । কিন্তু আমাকে কেন বলছি, দায় নিতে যে পারে না তার উপরে দায় চাপাতে ।” “ দেখছ-না লাবণ্য, ওর অমন দুরন্ত মন আজকাল অনেকখানি যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। দেখে আমার বড়ো মায়া করে । যাই বল, ও তোমাকে ভালোবাসে ।” “তা বাসেন ।” “তবে আর ভাবনা কিসের ” “কর্তা-মা, ওঁর যেটা স্বভাব তার উপর আমি একটুও অত্যাচার করতে চাই নে ৷” “আমি তো এই জানি লাবণ্য, ভালোবাসা খানিকটা অত্যাচার চায়, অত্যাচার করেও ।” “কর্তা-মা, সে অত্যাচারের ক্ষেত্ৰ আছে ; কিন্তু স্বভাবের উপর পীড়ন সয় মা । সাহিত্যে ভালোবাসার বই যতই পড়লেম ততই এই কথাটা বার বার আমার মনে হয়েছে, ভালোবাসার ট্রাজেডি ঘটে। সেইখানেই যেখানে পরস্পরকে স্বতন্ত্র জেনে মানুষ সন্তুষ্ট থাকতে পারে নি, নিজের ইচ্ছেকে * অন্যের ইচ্ছে করবার জন্যে যেখানে জুলুম, যেখানে মনে করি আপন মনের মতো করে বদলিয়ে অন্যকে সৃষ্টি করব।” “তা মা, দুজনকে নিয়ে সংসার পাততে গেলে পরস্পর পরস্পরকে খানিকটা সৃষ্টি না করে নিলে চলেই না। ভালোবাসা যেখানে আছে সেখানে সেই সৃষ্টি সহজ, যেখানে নেই সেখানে হাতুড়ি পিটােতে গিয়ে, তুমি যাকে ট্রাজেডি বল, তাই ঘটে ।” “সংসার পাতবার জন্যেই যে মানুষ তৈরি তার কথা ছেড়ে দাও । সে তো মাটির মানুষ, সংসারের প্রতিদিনের চাপেই তার গড়নপিটােন আপনি ঘটতে থাকে । কিন্তু, যে মানুষ মাটির মানুষ একেবারেই নয়। সে আপনার স্বাতন্ত্র্য কিছুতেই ছাড়তে পারে না । যে মেয়ে তা না বোঝে সে যতই দাবি করে ততই হয় বঞ্চিত, যে পুরুষ তা না বােঝে সে যতই টানাহেঁচড়া করে ততই আসল মানুষটাকে হারায় । আমার বিশ্বাস, অধিকাংশ স্থলেই আমরা যাকে পাওয়া বলি সে আর কিছু নয়, হাতকড়া হাতকে যেরকম পায় সেই আর-কি ?” “তুমি কী করতে চাও, লাবণ্য ।” “বিয়ে করে দুঃখ দিতে চাই নে। বিয়ে সকলের জন্যে নয়। জান কর্তা-মা, খুঁতখুঁতে মন যাদের তারা মানুষকে খানিক খানিক বাদ দিয়ে দিয়ে বেছে বেছে নেয়। কিন্তু বিয়ের ফঁাদে জড়িয়ে পড়ে