পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা 8&S বুঝতেন না। বললে, “কর্তা-মা, কালের গতিকে মানুষের মন যতই স্পষ্ট করে সব কথা বুঝতে পারবে ততই শক্ত করে তার ধাক্কা সইতেও পারবে । অন্ধকারের ভয়, অন্ধকারের দুঃখ অসহ্য, কেননা সেটা অস্পষ্ট ।” যোগমায়া বললেন, “আজ আমার বোধ হচ্ছে, কোনোকালে তোমাদের দুজনের দেখা না হলেই ভালো হত ।” “না না, তা বোলো না । যা হয়েছে। এ ছাড়া আর কিছু যে হতে পারত এ আমি মনেও করতে পারি নে। এক সময়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আমি নিতান্তই শুকনো- কেবল বই পড়ব। আর পাস করব, এমনি করেই আমার জীবন কাটবে। আজ হঠাৎ দেখলুম, আমিও ভালোবাসতে পারি। আমার জীবনে এমন অসম্ভব যে সম্ভব হল এই আমার ঢের হয়েছে। মনে হয়, এতদিন ছায়া ছিলুম, এখন সত্য হয়েছি । এর চেয়ে আর কী চাই । আমাকে বিয়ে করতে বোলো না, কর্তা-মা ।” বলে চৌকি থেকে মেঝেতে নেমে যোগমায়ার কোলে মাথা রেখে কঁদিতে লাগল । s दोन-दळ গোড়ায় সবাই ঠিক করে রেখেছিল, অমিত দিন-পনেরোর মধ্যে কলকাতায় ফিরবে। নরেন মিত্তির খুব মোটা বাজি রেখেছিল যে, সাত দিন পেরোবে না। এক মাস যায়, দু মাস যায়, ফেরবার নামও নেই। শিলঙের বাসার মেয়াদ ফুরিয়েছে, রংপুরের কোন জমিদার এসে সেটা দখল করে বসল। অনেক খোজ করে যোগমায়াদের কাছাকাছি একটা বাসা পাওয়া গেছে । এক সময়ে ছিল গোয়ালার কি মালীর ঘর, তার পরে একজন কেরানির হাতে পড়ে তাতে গারিবি ভদ্রতার অল্প একটু আঁচ লেগেছিল। সে কেরানিও গেছে মরে, তারই বিধবা এটা ভাড়া দেয়। জানলা দরজা প্রভৃতির কার্পণ্যে ঘরের মধ্যে তেজ মরুৎ ব্যোম এই তিন ভূতেরই অধিকার সংকীর্ণ, কেবল বৃষ্টির দিনে আপ অবতীর্ণ হয় আশাতীত প্রাচুর্যের সঙ্গে আখ্যাত ছিদ্রপথ দিয়ে। ঘরের অবস্থা দেখে যোগমায়া একদিন চমকে উঠলেন । বললেন, “বাবা, নিজেকে নিয়ে এ কী পরীক্ষা চলেছে।” অমিত উত্তর করলে, “উমার ছিল নিরাহারের তপস্যা, শেষকালে পাতা পর্যন্ত খাওয়া ছেড়েছিলেন । আমার হল নিরাসবাবের তপস্যা- খাট পালঙ টেবিল কেদারা ছাড়তে ছাড়তে প্ৰায় এসে ঠেকেছে। শূন্য দেয়ালে। সেটা ঘটেছিল হিমালয় পর্বতে, এটা ঘটল শিলঙ পাহাড়ে। সেটাতে কন্যা চেয়েছিলেন বর, এটাতে বর চাচ্ছেন কন্যা । সেখানে নারদ ছিলেন ঘটক, এখানে স্বয়ং আছেন মাসিমা- এখন শেষ পর্যন্ত যদি কোনো কারণে কালিদাস এসে না পৌঁছতে পারেন। অগত্যা আমাকেই তার কাজটাও যথাসম্ভব। সারতে হবে ।” ۰ অমিত হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে, কিন্তু যোগমায়াকে ব্যথা দেয় । তিনি প্ৰায় বলতে গিয়েছিলেন আমাদের বাড়িতেই এসে থাকো- থেমে গেলেন । ভাবলেন, বিধাতা একটা কাণ্ড ঘটিয়ে তুলছেন, তার মধ্যে আমাদের হাত পড়লে অসাধ্য জট পাকিয়ে উঠতে পারে। নিজের বাসা থেকে অল্প-কিছু জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিলেন, আর সেইসঙ্গে এই লক্ষ্মীছাড়াটার পরে তঁর করুণা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। লাবণ্যকে বার বার বললেন, “মা লাবণ্য, মনটাকে পাষাণ কোরো না।” একদিন বিষম এক বর্ষণের অন্তে অমিত কেমন আছে খবর নিতে গিয়ে যোগমায়া দেখলেন, . নড়বড়ে একটা চারপেয়ে টেবিলের নীচে কম্বল পেতে অমিত একলা বসে একখানা ইংরেজি বই পড়ছে। ঘরের মধ্যে যেখানে-সেখানে বৃষ্টিবিন্দুর অসংগত আবির্ভাব দেখে টেবিল দিয়ে একটা গুহা বানিয়ে তার নীচে অমিত পা ছড়িয়ে বসে গেল। প্রথমে নিজে নিজেই হেসে নিলে একচেট, তার পরে চলল কাব্যালোচনা । মনটা ছুটেছিল যোগমায়ার বাড়ির দিকে । কিন্তু শরীরটা দিলে বাধা । কারণ, যেখানে” কোনো প্রয়োজন হয় না। সেই কলকাতায় অমিত কিনেছিল এক অনেক দামের বর্ষতি, tOS