পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা 8ᏱᏄ SS মিলন-তত্ত্ব ঠিক হয়ে গেল, আগামী অম্লান মাসে এদের বিয়ে । যোগমায়া কলকাতায় গিয়ে সমস্ত আয়োজন করবেন । লাবণ্য অমিতকে বললে, “তোমার কলকাতায় ফেরবার দিন অনেককাল হল পেরিয়ে গেছে । অনিশ্চিতের মধ্যে বাধা পড়ে তোমার দিন কেটে যাচ্ছিল। এখন ছুটি । নিঃসংশয় চলে যাও । বিয়ের আগে আমাদের আর দেখা হবে না ।” “এমন কড়া শাসন কেন ।” “সেদিন যে সহজ আনন্দের কথা বলেছিলে তাকে সহজ রাখবার জন্যে ।” “এটা একেবারে গভীর জ্ঞানের কথা। সেদিন তােমাকে কবি বলে সন্দেহ করেছিলুম, আজ সন্দেহ করছি ফিলজফার বলে । চমৎকার বলেছ। সহজকে সহজ রাখতে হলে শক্ত হতে হয় । ছন্দকে সহজ করতে চাও তো যতিকে ঠিক জায়গায় কষে। আঁটতে হবে । লোভ বেশি, তাই জীবনের কাব্যে কোথাও যতি দিতে মন সরে না, ছন্দ ভেঙে গিয়ে জীবনটা হয় গীতহীন বন্ধন । আচ্ছা, কালই চলে যাব, একেবারে হঠাৎ, এই ভরা দিনগুলোর মাঝখানে । মনে হবে যেন মেঘনাদবধ কাব্যের সেই চমকে {थ-यां९3शी व्रश्नो চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে ! শিলঙ থেকে আমিই নাহয় চললুম, কিন্তু পাজি থেকে অম্লান মাস তো ফস করে পালাবে না। কলকাতায় গিয়ে কী করব জান ।” “কী করবে। ” 单 “মাসিমা যতক্ষণ করবেন বিয়ের দিনের ব্যবস্থা ততক্ষণ আমাকে করতে হবে তার পরের দিনগুলোর আয়োজন। লোকে ভুলে যায়, দাম্পত্যটা একটা আর্ট, প্রতিদিন ওকে নূতন করে সৃষ্টি করা চাই। মনে আছে বন্যা, রঘুবংশে অজ-মহারাজা ইন্দুমতীর কী বর্ণনা করেছিলেন।” লাবণ্য বললে, “প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধেী ।” অমিত বললে, “সেই ললিত কলাবিধিটা দাম্পত্যেরই। অধিকাংশ বর্বর বিয়েটাকেই মনে করে। মিলন, সেইজন্যে তার পর থেকে মিলনটাকে এত অবহেলা ।” “মিলনের আর্ট তোমার মনে কিরকম আছে বুঝিয়ে দাও । যদি আমাকে শিষ্যা করতে চাও। আজই তার প্রথম পাঠ শুরু হােক ৷” r “আচ্ছা, তবে শোনো। ইচ্ছাকৃত বাধা দিয়েই কবি ছন্দের সৃষ্টি করে। মিলনকেও সুন্দর করতে হয় ইচ্ছাকৃত বাধায় । চাইলেই পাওয়া যায়, দামি জিনিসকে এত সস্তা করা নিজেকেই ঠকানো। কেননা, শক্ত করে দাম দেওয়ার আনন্দটা বড়ো কম নয় ।” “দামের হিসাবটা শুনি ।” “রোসো, তার আগে আমার মনে যে ছবিটা আছে বলি । গঙ্গার ধার, বাগানটা ডায়মন্ডহার্বারের ঐ দিকটাতে । ছোটাে একটি স্টীম লঞ্চ করে ঘন্টা-দুয়েকের মধ্যে কলকাতায় যাতায়াত করা যায়।” “আবার কলকাতায় কী দরকার পড়ল ।” “এখন কোনো দরকার নেই, সে কথা জােন। যাই বটে বার-লাইব্রেরিতে, ব্যাবসা করি নে, দাবা খেলি । অ্যাটর্নিরা বুঝে নিয়েছে, কাজে গরজ নেই তাই মন নেই। কোনো আপসের মকদ্দমা হলে তার শ্ৰীফ আমাকে দেয়, তার বেশি আর কিছুই দেয় না। কিন্তু বিয়ের পরেই দেখিয়ে দেব কাজ কাকে বলে- জীবিকার দরকারে নয়, জীবনের দরকারে । আমের মাঝখানটাতে থাকে আঁঠি, সেটা মিষ্টিও নয়, নরমও নয়, খাদ্যও নয় ; কিন্তু ঐ শক্তটাই সমস্ত আমের আশ্রয়, ঐটাতেই সে আকার পায় ।