পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা Qの& অত্যন্ত স্পষ্ট করে প্রকাশ পাচ্ছে চার দিকের ছবিটা ; পাহাড়ের আর গাছপালার সীমান্তগুলি যেন ঘননীল আকাশে খুদে-দেওয়া, জগৎটা যেন কাছে এগিয়ে একেবারে মনের উপরে এসে ঠেকাল । আস্তে আস্তে বেলা চলে যাচ্ছে, তার ভিতরটাতে ভৈরবীর সুর। এখনই খুব কষে কাজে লাগবে বলে। লাবণ্যর পণ ছিল, তবু যখন দূর থেকে দেখলে অমিত গাছতলায় বসে, আর থাকতে পারলে না, বুকের ভিতরটা হাঁপিয়ে উঠল, চােখ এল জলে ছলছলিয়ে। কাছে এসে বললে, “মিতা, তুমি কী ভাবছ।” “এতদিন যা ভাবছিলুম। একেবারে তার উলটাে ।” “মাঝে মাঝে মনটাকে উলটিয়ে না দেখলে তুমি ভালো থাক না। তা তোমার উলটাে ভাবনাটা কিরকম শুনি ।” “তোমাকে মনের মধ্যে নিয়ে এতদিন কেবল ঘর বানাচ্ছিলুম- কখনো গঙ্গার ধারে, কখনো পাহাড়ের উপরে । আজ মনের মধ্যে জাগছে। সকালবেলাকার আলোয় উদাস-করা একটা পথের ছবি- অরণ্যের ছায়ায় ছায়ায় ঐ পাহাড়গুলোর উপর দিয়ে । হাতে আছে লোহার-ফলা-ওয়ালা লম্বা লাঠি, পিঠে আছে চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে বাধা একটা চৌকো থলি । তুমি চলবে সঙ্গে । তোমার নাম সার্থক হােক বন্যা, তুমি আমাকে বদ্ধ ঘর থেকে বের করে পথে ভাসিয়ে নিয়ে চললে বুঝি। ঘরের মধ্যে নানান লোক, পথ কেবল দুজনের ” “ডায়মন্ডহার্বারের বাগানটা তো গেছেই, তার পরে সেই পঁচাত্তর টাকার ঘর-বেচারাও গেল। তা যাক গে। কিন্তু চলাবার পথে বিচ্ছেদের ব্যবস্থােটা কিরকম করবে। দিনান্তে তুমি এক পান্থশালায় ঢুকবে আর আমি আর-একটাতে ?” “তার দরকার হয় না বন্যা । চলাতেই নতুন রাখে, পায়ে পায়ে নতুন, পুরোনো হবার সময় পাওয়া যায় না। বসে-থাকাটাই বুড়োমি ।” “হঠাৎ এ খেয়ালটা তোমার কেন মনে হল মিতা ।” “তবে বলি। হঠাৎ শোভনলালের কাছ থেকে একখানা চিঠি পেয়েছি। তার নাম শুনেছ বোধ হয়- রায়চাঁদ-প্রেমচাঁদ-ওয়ালা। ভারত-ইতিহাসের সাবেক পথগুলো সন্ধান করবে বলে কিছুকাল মুকুরে পড়ছে। সে অতীতের গুপ্তপথ উদ্ধার কাতে চায়। আমরাইজ ছবিতের পথ করা ।” লাবণ্যর বুকের ভিতরে হঠাৎ খুব একটা ধাক্কা দিলে। কথাটাকে বাধা দিয়ে অমিতকে বললে, “শোভনলালের সঙ্গে একই বৎসর আমি এম. এ. দিয়েছি। তার সব খবরটা শুনতে ইচ্ছে করে ।” “এক সময়ে সে খেপেছিল, আফগানিস্থানের প্রাচীন শহর কপিাশের ভিতর দিয়ে একদিন যে পুরোনো রাস্তা চলেছিল। সেইটেকে আয়ত্ত করবে। ঐ রাস্তা দিয়েই ভারতবর্ষে হিউয়েন সাঙের তীর্থযাত্রা, ঐ রাস্তা দিয়েই তারও পূর্বে আলেকজাণ্ডারের রণযাত্রা। খুব কষে পুশতু পড়লে, পাঠনি কায়দাকানুন অভ্যোস করলে। সুন্দর চেহারা, টিলে কাপড়ে ঠিক পাঠানের মতো দেখতে হয় না, দেখায় যেন পারসিকের মতো”। আমাকে এসে ধরলে, সেখানে ফরাসি পণ্ডিতরা এই কাজে লেগেছেন, তাদের কাছে পরিচয়পত্র দিতে। ফ্রান্সে থাকতে তাদের কারও কারও কাছে আমি পড়েছি। দিলেম পত্র, কিন্তু ভারত-সরকারের ছাড়চিঠি জুটল না। তার পর থেকে দুৰ্গম হিমালয়ের মধ্যে কেবলই পথ । খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কখনো কাশ্মীরে কখনো কুমায়ুনে । এবার ইচ্ছে হয়েছে, হিমালয়ের পূর্বপ্রান্তটাতেও সন্ধান করবে। বৌদ্ধধর্মপ্রচারের রাস্তা। এ দিক দিয়ে কোথায় কোথায় গেছে সেইটে দেখতে চায়। ঐ পথ-খেপটার কথা মনে করে আমারও মন উদাস হয়ে যায়। পুঁথির মধ্যে আমরা কেবল কথার রাস্তা খুঁজে খুঁজে চোখ খোওয়াই, ঐ পাগল বেরিয়েছে। পথের পুঁথি পড়তে, মানববিধাতার নিজের হাতে লেখা । আমার কী মনে হয় জান ?” “কী, বলো।” r “প্ৰথম যৌবনে একদিন শোভনলাল কোন কঁাকন-পরা হাতের ধাক্কা খেয়েছিল, তাই ঘরের থেকে