পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ł R রবীন্দ্র-রচনাবলী লক্ষ করে তাতে যেন আধ খোলা একটা ছুরির ঝলক থাকে। প্রথম-বয়সে ঠোঁটদুটিতে সরল মাধুর্য ছিল এখন বার বার বেঁকে বেঁকে তার মধ্যে বঁাকা অন্ধুশের মতো ভাব স্থায়ী হয়ে গেছে। মেয়েদের বেশের বর্ণনায় আমি আনাড়ি । তার পরিভাষা জানি নে । মোটের উপর চোখে পড়ে, উপরে একটা পাতলা সাপের খোলসের মতো ফুরফুরে আবরণ, অন্দরের কাপড় থেকে অন্য একটা রঙের আভাস আসছে। বুকের অনেকখানিই অনাবৃত ; আর অনাবৃত বাহুদুটিকে কখনো কখনো টেবিলের, কখনো চৌকির হাতায়, কখনাে পরস্পরকে জড়িত করে যত্নের ভঙ্গিতে আলগোছে রাখবার সাধনা সুসম্পূৰ্ণ । আর, যখন সুমার্জিতনখররমণীয় দুই আঙুলে চেপে সিগারেট খায় সেটা যতটা অলংকরণের অঙ্গরূপে ততটা ধূমপানের উদ্দেশে নয়। সব চেয়ে যেটা মনে দুশ্চিন্তা উদ্রেক করে সেটা ওর সমুচ্চ-খুর-ওয়ালা জুতোজোড়ার কুটিল ভঙ্গিমায় ; যেন ছাগল-জাতীয় জীবের আদর্শ বিস্মৃত হয়ে মানুষের পায়ের গড়ন দেবার বেলায় সৃষ্টিকর্তা ভুল করেছিলেন, যেন মুচির দত্ত পদোন্নতির কিস্তৃত বক্রতায় ধরণীকে পীড়ন করে চলার দ্বারা এভোলুশনের ত্রুটি সংশোধন করা হয় । সিসি এখনো আছে মাঝামাঝি জায়গায় । শেষের ডিগ্রি এখনো পায় নি, কিন্তু ডবল প্রোমোশন পেয়ে চলেছে। উচ্চ হাসিতে, অজস্র খুশিতে, অনর্গল আলাপে। ওর মধ্যে সর্বদা একটা চলন-বলন টগবগ করছে, উপাসকমণ্ডলীর কাছে সেটার খুব আদর। রাধিকার বয়ঃসন্ধির বর্ণনায় দেখতে পাওয়া যায়, কোথাও তার ভাবখানা পাকা, কোথাও কঁাচা-এরও তাই। খুরওয়ালা জুতোয় যুগান্তরের জয়তোরণ, কিন্তু অনবচ্ছিন্ন খোপাটাতে রয়ে গেছে অতীত যুগ ; পায়ের দিকে শাড়ির বহর ইঞ্চি দুই-তিন খাটাে, কিন্তু উত্তরচ্ছদে অসংবৃতির সীমানা এখনাে আলজ্জতার অভিমুখে ; অকারণ দস্তান পরা অভ্যস্ত, অথচ এখনো এক হাতের পরিবর্তে দুই হাতেই বালা ; সিগারেট টানতে আর মাথা ঘোরে না, কিন্তু পান খাবার আসক্তি এখনো প্রবল ; বিস্কুটের টিনে ঢেকে আচার-আমসত্ত্ব পাঠিয়ে দিলে সে আপত্তি করে না ; ক্রিস্টমাসের প্লাম পুডিং এবং পৌষপার্বণের পিঠে, এই দুইয়ের মধ্যে শেষটার প্রতিই তার লোলুপতা কিছু বেশি। ফিরিঙ্গি নাচওয়ালির কাছে সে নােচ শিখছে, কিন্তু নাচের সভায় জুড়ি মিলিয়ে ঘূর্ণিনাচ নাচতে সামান্য একটু সংকোচ বোধ করে। অমিত সম্বন্ধে জনরব শুনে এরা বিশেষ উদবিগ্ন হয়ে চলে এসেছে। বিশেষত এদের পরিভাষাগত শ্রেণীবিভাগে লাবণ্য গবর্নেস। ওদের শ্রেণীর পুরুষের জাত মারবার জন্যেই তার “স্পেশাল ক্রিয়েশন"। মনে সন্দেহ নেই, টাকার লোভে মানের লোভেই সে অমিতকে কষে আঁকড়ে ধরেছে, ছাড়াতে গেলে সেই কাজটাতে মেয়েদের সম্মার্জনপটু হস্তক্ষেপ করতে হবে । চতুর্মুখ তার চার জোড়া চক্ষে মেয়েদের দিকে কটাক্ষপাত ও পক্ষপাত একসঙ্গেই করে থাকবেন, সেইজন্যে মেয়েদের সম্বন্ধে বিচারবুদ্ধিতে পুরুষদের গড়েছেন নিরেট নির্বোধ করে। তাই স্বজাতিমোহমুক্ত আত্মীয়-মেয়েদের সাহায্য না পেলে অনাত্মীয় মেয়েদের মোহজাল থেকে পুরুষদের উদ্ধার পাওয়া এত দুঃসাধ্য। আপাতত এই উদ্ধারের প্রণালীটা কিরকম হওয়া চাই তাই নিয়ে দুই নারী নিজেদের মধ্যে একটা পরামর্শ ঠিক করেছে। এটা নিশ্চিত, গােড়ায় অমিতকে কিছুই জানতে দেওয়া হবে না। তার আগেই শত্ৰুপক্ষকে আর রণক্ষেত্রটাকে দেখে আসা চাই । তার পর দেখা যাবে মায়াবিনীর কত শক্তি । প্রথমে এসেই চােখে পড়ল অমিতার উপর ঘন এক পোচ গ্ৰাম্য রঙ । এর আগেও ওর দলের সঙ্গে । অমিতার ভাবের মিল ছিল না। তবু সে তখন ছিল প্রখর নাগরিক, চাচা মাজা ঝকঝকে । এখন কেবল যে খোলা হাওয়ায় রঙটা কিছু ময়লা হয়েছে তা নয়, সবসুদ্ধ ওর উপর যেন গাছপালার আমেজ দিয়েছে। ও যেন কঁচা হয়ে গেছে এবং ওদের মতে কিছু যেন বোকা । ব্যবহারটা প্রায় যেন সাধারণ মানুষের মতো। আগে জীবনের সমস্ত বিষয়কে হাসির অন্ত্র নিয়ে তাড়া করে বেড়ােত, এখন ওর সে শখ নেই বললেই হয় । এইটোকেই ওরা মনে করেছে নিদেন কালের লক্ষণ । । সিসি একদিন ওকে স্পষ্টই বললে, “দূর থেকে আমরা মনে করছিলুম তুমি বুঝি খাসিয়া হবার দিকে নামছ। এখন দেখছি তুমি হয়ে উঠছ, যাকে বলে গ্ৰীন, এখানকার পাইন গাছের মতো, হয়তো আগেকার চেয়ে স্বাস্থ্যকর, কিন্তু আগেকার মতো ইন্টারেস্টিং নয়।” ।