পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G*Sbr রবীন্দ্র-রচনাবলী চেনেন না, আমাকে ধোক লাগিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু আমার মন বললে, ঘুরে ফিরে ওকে ওর এই গোরস্থানে আসতেই হবে ।” সিসি উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল। কেটি লাবণ্যকে বললে, “আমিট আপনার নাম মুখে আনলে না, মধুর ভাষাতে ঘুরিয়ে বললে কমললেবুর মধু ; আপনার বুদ্ধি খুবই বেশি সরল, ঘুরিয়ে বলবার কৌশল মুখে জোগায় না, ফস করে বলে ফেললেন অমিটকে জানেনই না। তবু সানডে স্কুলের বিধানমত ফল ফলিল না, দণ্ডদাতা আপনাদের কোনো দণ্ডই দিলেন না, শক্ত পথের মধুও একজন এক চুমুকেই খেয়ে নিলেন আর অজানাকেও একজন এক দৃষ্টিতেই জানলেন- এখন কেবল আমার ভাগেই হার হবে ? দেখো তো সিসি, কী অন্যায় ।” সিসির আবার সেই উচ্চ হাসি। ট্যাবি-কুকুরটাও এই উচ্ছাসে যোগ দেওয়া তার সামাজিক কর্তব্য মনে করে বিচলিত হবার লক্ষণ দেখালে। তৃতীয়বার তাকে দমন করা হল। কেটি বললে, “আমিট, তুমি জান, এই হীরের আংটি যদি হারি, জগতে আমার সাস্তুনা থাকবে না। এই আংটি একদিন তুমিই দিয়েছিলে। এক মুহূর্ত হাত থেকে খুলি নি, এ আমার দেহের সঙ্গে এক হয়ে গেছে। শেষকালে আজ এই শিলঙ পাহাড়ে কি একে বাজিতে খোয়াতে হবে ।” সিসি বললে, “বাজি রাখতে গেলে কেন ভাই ।” “মনে মনে নিজের উপর অহংকার ছিল, আর মানুষের উপর ছিল বিশ্বাস। অহংকার ভাঙলএবারকার মতো আমার রেস ফুরোল, আমারই হার । মনে হচ্ছে, আমিটকে আর রাজি করতে পারব না। তা, এমন অদ্ভুত করেই যদি হারাবে, সেদিন এত আদরে আংটি দিয়েছিলে কেন। সে দেওয়ার মধ্যে কি কোনো বাধন ছিল না । এই দেওয়ার মধ্যে কি কথা ছিল না যে, আমার অপমান কোনোদিন তুমি ঘটতে দেবে না।” বলতে বলতে কেটির গলা ভার হয়ে এল, অনেক কষ্টে চোখের জল সামলে নিলে । আজ সাত বৎসর হয়ে গেল, কেটির বয়স তখন আঠারো । সেদিন এই আংটি অমিত নিজের আঙুল থেকে খুলে ওকে পরিয়ে দিয়েছিল। তখন ওরা দুজনেই ছিল ইংলন্ডে। অক্সফোর্ডে একজন পাঞ্জাবী যুবক ছিল কেটির প্রণয়মুগ্ধ। সেদিন আপসে অমিত সেই পাঞ্জাবীর সঙ্গে নদীতে বাচ খেলেছিল। অমিতরই হল জিত। জুন মাসের জ্যোৎস্নায় সমস্ত আকাশ যেন কথা বলে উঠেছিল, মাঠে মাঠে ফুলের প্রচুর বৈচিত্র্যে ধরণী, তার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। সেই ক্ষণে অমিত কেটির হাতে আংটি পরিয়ে দিলে । তার মধ্যে অনেক কথাই উহ্য ছিল, কিন্তু কোনো কথাই গোপন ছিল না । সেদিন কেটির মুখে প্রসাধনের প্রলেপ লাগে নি, তার হাসিটি সহজ ছিল, ভাবের আবেগে তার মুখ রক্তিম হতে বাধা পেত না । আংটি হাতে পরা হলে অমিত তার কানে কানে বলেছিল Tender is the night And haply the queen moon is on her throne. কেটি তখন বেশি কথা বলতে শেখে নি। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কেবল যেন মনে মনে বলেছিল “মন আমী”, ফরাসি ভাষায় যার মানে হচ্ছে “বধু ! আজ অমিতার মুখেও জবাব বেধে গেল। ভেবে পেলে না। কী বলবে। কেটি বললে, “বাজিতে যদিই হারলুম। তবে আমার এই চিরদিনের হারের চিহ্ন তোমার কাছেই থাক অমিট । আমার হাতে রেখে একে আমি মিথ্যে কথা বলতে দেব না।” বলে আংটি খুলে টেবিলটার উপর রেখেই দ্রুতবেগে চলে গেল। এনামেলকরা মুখের উপর দিয়ে দর দর করে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।