পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२० রবীন্দ্র-রচনাবলী “কিন্তু মিতা, নিজেকে যে একদিন সম্পূর্ণ তোমার হাতে উৎসর্গ করেছিল তাকে তুমি আপনার করে রাখলে না কেন । যে কারণেই হােক, আগে তোমার মুঠে আলগা হয়েছে, তার পরে দশের মুঠোর চাপ পড়েছে। ওর উপরে, ওর মূর্তি গেছে বদলে। তোমার মন একদিন হারিয়েছে বলেই দশের মনের মতো করে নিজেকে সাজাতে বসল। আজ তো দেখি, ও বিলিতি দোকানের পুতুলের মতো ; সেটা সম্ভব হত না, যদি ওর হৃদয় বেঁচে থাকত। থাক গে ও-সব কথা। তোমার কাছে আমার একটা প্রার্থনা আছে ৷ রাখতে হবে ।” “বলো, নিশ্চয় রাখব।” “অন্তত হস্তাখানেকের জন্যে তোমার দলকে নিয়ে তুমি চেরাপুঞ্জিতে বেড়িয়ে এসো। ওকে আনন্দ দিতে নাও যদি পাের, ওকে আমোদ দিতে পারবে ।” অমিত একটুখানি চুপ করে থেকে বললে, “আচ্ছা।” তার পরে লাবণ্য অমিতার বুকে মাথা রেখে বললে, “একটা কথা তোমাকে বলি মিতা, আর কোনোদিন বলব না । তোমার সঙ্গে আমার যে অন্তরের সম্বন্ধ তা নিয়ে তোমার লেশমাত্র দায় নেই। আমি রাগ করে বলছি নে, আমার সমস্ত ভালোবাসা দিয়েই বলছি, আমাকে তুমি আংটি দিয়ে না, কোনো চিহ্ন রাখবার কিছু দরকার নেই। আমার প্রেম থাক নিরঞ্জন ; বাইরের রেখা, বাইরের ছায়া তাতে পড়বে না।” 辆 এই বলে নিজের আঙুলের থেকে আংটি খুলে অমিতর আঙুলে আস্তে আস্তে পরিয়ে দিলে। অমিত তাতে কোনো বাধা দিলে না । সায়হ্নের এই পৃথিবী যেমন অস্তরশ্মি উদদ্ভাসিত আকাশের দিকে নিঃশব্দে আপন মুখ তুলে : তেমনি নীরবে, তেমনি শান্ত দীপ্তিতে লাবণ্য আপন মুখ তুলে ধরলে অমিতর নত মুখের

  • ዮ i

সাত দিন যেতেই অমিত ফিরে যোগমায়ার সেই বাসায় গেল । ঘর বন্ধ, সবাই চলে গেছে। কোথায় গেছে তার কোনো ঠিকানা রেখে যায় নি । সেই যুক্যালিপটাস গাছের তলায় অমিত এসে দাঁড়াল, খানিকক্ষণ ধরে শূন্যমনে সেইখানে ঘুরে বেড়ালে। পরিচিত মালী এসে সেলাম করে জিজ্ঞাসা করলে, “ঘর খুলে দেব কি। ভিতরে বসবেন ?” অমিত একটু দ্বিধা করে বললে, “হাঁ।” Վ. ভিতরে গিয়ে লাবণ্যর বসবার ঘরে গেল। চৌকি টেবিল শেলফ আছে, সেই বইগুলি নেই। মেজের উপর দুই-একটা ছেঁড়া শূন্য লেফাফা, তার উপরে অজানা হাতের অক্ষরে লাবণ্যর নাম ও ঠিকানা লেখা ; দু-চারটে ব্যবহার করা পরিত্যক্ত নিব এবং ক্ষয়প্রাপ্ত একটি অতি ছােটাে পেনসিল টেবিলের উপরে। পেনসিলটি পকেটে নিলে। এর পাশেই শোবার ঘর। লোহার খাটে কেবল একটা গদি, আর আয়নার টেবিলে একটা শূন্য তেলের শিশি । দুই হাতে মাথা রেখে অমিত সেই গদির উপর শুয়ে পড়ল, লোহার খাটটা শব্দ করে উঠল। সেই ঘরটার মধ্যে বোবা একটা শূন্যতা। তাকে প্রশ্ন করলে কোনো কথাই বলতে পারে না। সে একটা মূৰ্ছা, যে মূৰ্ছা কোনোদিনই আর ভাঙবে না। তার পরে শরীরমনের উপর একটা নিরুদ্যমের বোঝা বহন করে অমিত গৈল নিজের কুটিরে। যা যেমন রেখে গিয়েছিল তেমনিই সব আছে। এমন-কি, যোগমায়া তীর কেদারাটিও ফিরিয়ে নিয়ে যান নি। বুঝলে, তিনি স্নেহ করেই এই চোকিটি তাকে দিয়ে গেছেন, মনে হল যেন শুনতে পেলে শান্ত মধুর স্বরে তীর সেই আহবান- বাছা! সেই চৌকির সামনে মাথা লুটিয়ে অমিত প্ৰণাম করলে। সমস্ত শিলঙ পাহাড়ের শ্ৰী আজ চলে গেছে। অমিত কোথাও আর সাত্বনা পেল না ।