পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(?S)や রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রিয়পাত্র থাক কখনো সম্মানের অধিকারী ছিল না। যেখানে গভীরভাবে কোনো বিষয়ের আলোচনা হইত। সেখানে হাস্যের চপলতা সর্বপ্রযত্নে পরিহার করা হইত । বঙ্কিম সর্বপ্রথমে হাস্যরসকে সাহিত্যের উচ্চশ্রেণীতে উন্নীত করেন । তিনিই প্রথম দেখাইয়া দেন যে, কেবল প্রহসনের সীমার মধ্যে হাস্যরস বদ্ধ নহে ; উজ্জ্বল শুভ্ৰ হাস্য সকল বিষয়কেই আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে। তিনিই প্ৰথম দৃষ্টাস্তের দ্বারা প্রমাণ করাইয়া দেন যে, এই হাস্যজ্যোতির সংস্পর্শে কোনো বিষয়ের গভীরতার গৌরব হ্রাস হয় না, কেবল তাহার সৌন্দর্য এবং রমণীয়তার বৃদ্ধি হয়, তাহার সর্বাংশের প্রাণ এবং গতি যেন সুস্পষ্টরূপে দীপ্যমান হইয়া উঠে। যে বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যের গভীরতা হইতে অশ্রুর উৎস উন্মুক্ত করিয়াছেন সেই বঙ্কিম আনন্দের উদয়শিখর হইতে নবজাগ্রত বঙ্গসাহিত্যের উপর হাস্যের আলোক বিকীর্ণ করিয়া দিয়াছেন। কেবল সুসংগতি নহে, সুরুচি এবং শিষ্টতার সীমা নির্ণয় করিতেও একটি স্বাভাবিক সূক্ষ্ম বোধশক্তির আবশ্যক । মাঝে মাঝে অনেক বলিষ্ঠ প্ৰতিভার মধ্যে সেই বোধশক্তির অভাব দেখা যায় । কিন্তু বঙ্কিমের প্রতিভায় বল এবং সীেকুমার্যের একটি সুন্দর সংমিশ্রণ ছিল। নারীজাতির প্রতি যথার্থ বীরপুরুষের মনে যেরূপ একটি সসন্ত্ৰম সম্মানের ভাব থাকে তেমনি সুরুচি এবং শীলতার প্রতি বঙ্কিমের বলিষ্ঠবুদ্ধির একটি বীরোচিত গ্ৰীতিপূর্ণ শ্রদ্ধা ছিল। বঙ্কিমের রচনা তাহার সাক্ষ্য। বর্তমান লেখক যেদিন প্রথম বঙ্কিমকে দেখিয়াছিল, সেদিন একটি ঘটনা ঘটে যাহাতে বঙ্কিমের এই স্বাভাবিক সুরুচিপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সেদিন লেখকের আত্মীয় পূজ্যপাদ শ্ৰীযুক্ত শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহােদয়ের নিমন্ত্রণে র্তাহাদের মরকতকুঞ্জে কলেজ-রিয়ানিয়ন নামক মিলনসভা বসিয়াছিল। ঠিক কতদিনের কথা স্মরণ নাই, কিন্তু আমি তখন বালক ছিলাম। সেদিন সেখানে আমার অপরিচিত বহুতর যশস্বী লোকের সমাগম হইয়াছিল। সেই বুধমণ্ডলীর মধ্যে একটি ঋজু দীর্ঘকায় উজ্জ্বলকীেতুকপ্রফুল্লমুখ গুম্ফাধারী প্রৌঢ় পুরুষ চাপকনপরিহিত বক্ষের উপর দুই হস্ত আবদ্ধ করিয়া দাড়াইয়া ছিলেন। দেখিবামাত্রই যেন তঁহাকে সকলের হইতে স্বতন্ত্র এবং আত্মসমাহিত বলিয়া বোধ হইল। আর সকলে জনতার অংশ, কেবল তিনি যেন একাকী একজন । সেদিন আর-কাহারও পরিচয় জানিবার জন্য আমার কোনোরূপ প্ৰয়াস জন্মে নাই, কিন্তু তঁহাকে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ আমি এবং আমার একটি আত্মীয় সঙ্গী একসঙ্গেই কৌতুহলী হইয়া উঠিলাম। সন্ধান লইয়া জানিলাম। তিনিই আমাদের বহুদিনের অভিলষিতদর্শন লোকবিশ্রুত বঙ্কিমবাবু ; মনে আছে, প্রথম দর্শনেই তঁহার মুখশ্ৰীতে প্ৰতিভার প্রখরতা এবং বলিষ্ঠতা এবং সর্বলোক হইতে র্তাহার একটি সুদূর স্বাতন্ত্র্যভােব আমার মনে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। তাহার পর অনেক বার তাহার সাক্ষাৎলাভ করিয়াছি, তাহার নিকট অনেক উৎসাহ এবং উপদেশ প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং তঁাহার মুখশ্ৰী মেহের কোমলহাস্যে অত্যন্ত কমনীয় হইতে দেখিয়াছি, কিন্তু প্ৰথম দর্শনে সেই-যে র্তাহার মুখে উদ্যত খড়েগর ন্যায় একটি উজ্জ্বল সুতীক্ষা প্রবলতা দেখিতে পাইয়াছিলাম, তাহা আজি পর্যন্ত বিস্মৃত হই নাই। সেই উৎসব উপলক্ষে একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেশানুরাগমূলক স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক পাঠ এবং তাহার ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। বঙ্কিম এক প্রান্তে দাড়াইয়া শুনিতেছিলেন । পণ্ডিতমহাশয় সহসা একটি শ্লোকে পতিত ভারতসন্তানকে লক্ষ্য করিয়া একটা অত্যন্ত সেকেলে পণ্ডিত রসিকতা প্রয়ােগ করিলেন, সে রস কিঞ্চিৎ বীভৎস হইয়া উঠিল। বঙ্কিম তৎক্ষণাৎ একান্ত সংকুচিত হইয়া দক্ষিণকরতলে মুখের নিম্নার্ধ ঢাকিয়া পার্শ্ববতী দ্বার দিয়া দ্রুতবেগে অন্য ঘরে পলায়ন করিলেন । * বঙ্কিমের সেই সসংকোচ পলায়নদৃশ্যটি অদ্যাবধি আমার মনে মুদ্রাঙ্কিত হইয়া আছে। বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে, ঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্যগুরু ছিলেন বঙ্কিম তখন র্তাহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন। সে সময়কার সাহিত্য অন্য যে-কোনাে প্রকার শিক্ষা দিতে সমর্থ হউক ঠিক সুরুচি শিক্ষার উপযোগী ছিল না । সে সময়কার অসংযত বাকযুদ্ধ এবং আন্দোলনের মধ্যে