পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Qやbr রবীন্দ্র-রচনাবলী করি, যিনি জীবনের সায়াহ্ন আসিবার পূর্বেই, নূতন অবকাশে নূতন উদ্যমে নূতন কার্যে হস্তক্ষেপ করিবার প্রারম্ভেই, আপনার অপরিস্নান প্ৰতিভারশ্মি সংহরণ করিয়া বঙ্গসাহিত্যাকাশ ক্ষীণতর জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর হন্তে সমর্পণপূর্বক গত শতাব্দীর বর্ষশেষের পশ্চিমদিগন্তসীমায় অকালে অস্তমিত হইলেন । বৈশাখ ১৩০১ বিহারীলাল বর্তমান নববর্ষের প্রারম্ভেই কবি বিহারীলাল চক্রবতীর পরলোকপ্ৰাপ্তি হইয়াছে। বঙ্গের সারস্বতকুঞ্জে মৃত্যু ব্যাধের ন্যায় প্রবেশ করিয়াছে। তাহার নিষ্ঠুর শরসন্ধানে অল্পকালের মধ্যে অনেকগুলি কণ্ঠ নীরব হইয়া গেল । তন্মধ্যে বিহারীলালের কণ্ঠ সাধারণের নিকট তেমন সুপরিচিত ছিল না। র্তাহার শ্রোতৃমণ্ডলীর সংখ্যা অল্প ছিল এবং তাহার সুমধুর সংগীত নির্জনে নিভৃতে ধ্বনিত হইতে থাকিত, খ্যাতির প্রার্থনায় পাঠক এবং সমালোচক -সমাজের দ্বারবতী হইত না । কিন্তু যাহারা দৈবক্রমে এই বিজনবাসী ভাবনিমগ্ন কবির সংগীতকাকলিতে আকৃষ্ট হইয়া তাহার কাছে আসিয়াছিল। তাহাদের নিকটে তঁাহার আদরের অভাব ছিল না । তাহারা তাহাকে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ कवि दक्लिशों उानिठ । বঙ্গদর্শন প্রকাশ হইবার বহুপূর্বে কিছুকাল ধরিয়া অবোধবন্ধু-নামক একটি মাসিক পত্র বাহির হইত। তখন বর্তমান লেখক বালকবয়সপ্রযুক্ত নিতান্ত অবোধ ছিল। কিঞ্চিৎ বয়ঃপ্ৰাপ্তিসহকারে যখন বোধোদয় হইল। তখন উক্ত কাগজ বন্ধ হইয়া গেল । সৌভাগ্যক্রমে পত্রগুলি কতক বাধানো কতক-বা খণ্ড আকারে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আলমারির মধ্যে রক্ষিত ছিল। অনেক মূল্যবান গ্রন্থাদি থাকাতে সে আলমারিতে চপলপ্রকৃতি বালকদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ ছিল। এক্ষণে নিৰ্ভয়ে স্বীকার করিতে পারি, অবােধবন্ধুর বন্ধুত্ব-প্রলোভনে মুগ্ধ হইয়া সে নিষেধ লঙ্ঘন করিয়াছিলাম। এই গোপন দুষ্কর্মের জন্য কোনোরূপ শাস্তি পাওয়া দূরে থাক, বহুকাল ধরিয়া যে আনন্দলাভ করিয়াছিলাম তাহা এখনো বিস্মৃত হই নাই। এখনো মনে আছে ইস্কুল ফাকি দিয়া একটি দক্ষিণদ্বারা ঘরে সুদীর্ঘ নির্জন মধ্যাহ্নে অবোধবন্ধু হইতে । পৌল-বর্জিনীর বাংলা অনুবাদ পাঠ করিতে করিতে প্রবল বেদনায় হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইত। তখন কলিকাতার বহির্বতী প্রকৃতি আমার নিকট অপরিচিত ছিল— এবং পীেল-বর্জিনীতে সমুদ্রতটের অরণ্যদৃশ্যবর্ণনা আমার নিকট অনির্বচনীয় সুখস্বপ্নের ন্যায় প্রতিভাত হইত, এবং সেই তরঙ্গাঘাতধ্বনিত বনচ্ছায়াস্নিগ্ধ সমুদ্রবেলায় পৌল-বর্জিনীর মিলন এবং বিচ্ছেদবেদনা হৃদয়ের মধ্যে যেন মূৰ্ছনাসহকারে অপূর্ব সংগীতের মতো বাজিয়া উঠিত। এই ক্ষুদ্র পত্রে যে-সকল গদ্যপ্ৰবন্ধ বাহির হইত, তাহার মধ্যে কিছু বিশেষত্ব ছিল। তখনকার বাংলা । গদ্যে সাধুভাষার অভাব ছিল না, কিন্তু ভাষার চেহারা ফোটে নাই। তখন র্যাহারা মাসিক পত্রে লিখিতেন তাহারা গুরু সাজিয়া লিখিতেন- এইজন্য র্তাহারা পাঠকদের নিকট আত্মপ্রকাশ করেন নাই এবং এইজন্যই তঁহাদের লেখার যেন একটা স্বরূপ ছিল না। যখন অবোধবন্ধু পাঠ করিতাম তখন তাহাকে ইস্কুলের পড়ার অনুবৃত্তি বলিয়া মনে হইত না। বাংলা ভাষায় বোধ করি সেই প্রথম মাসিক পত্র বাহির হইয়াছিল যাহার রচনার মধ্যে একটা স্বাদবৈচিত্ৰ্য পাওয়া যাইত । বর্তমান বঙ্গসাহিত্যের প্রাণসঞ্চারের ইতিহাস যাহারা পর্যালোচনা করিবেন তাহারা অবােধবন্ধুকে উপেক্ষা করিতে পরিবেন না। বঙ্গদর্শনকে যদি আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের প্রভাতসূর্য বলা যায়। তবে ক্ষুদ্রায়তন অবোধবন্ধুকে প্ৰত্যুষের শুকতারা বলা যাইতে পারে।