পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য 6ነ6ሱx© বিহঙ্গম, খুলে প্ৰাণ ধরো রে পঞ্চম তান, সারদামঙ্গলগান গাও কুতুহলে।” কবি যে সূত্রে ‘সারদামঙ্গলের এই কবিতাগুলি গাঁথিয়াছেন তাহা ঠিক ধরিতে পারিয়াছি কি না জানি না- মধ্যে মধ্যে সূত্র হারাইয়া যায়, মধ্যে মধ্যে উচ্ছাস উন্মত্ততায় পরিণত হয়- কিন্তু এ কথা বলিতে পারি। আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে প্রেমের সংগীত এরূপ সহস্ৰধার উৎসের মতো কোথাও উৎসারিত হয় নাই। এমন নির্মল সুন্দর ভাষা, এমন ভাবের আবেগ, কথার সহিত এমন সুরের মিশ্রণ আর কোথাও পাওয়া যায় না ; বর্তমান সমালোচক এককালে ‘বঙ্গসুন্দরী’ ও ‘সারদামঙ্গলের কবির নিকট হইতে কাব্যশিক্ষার চেষ্টা করিয়াছিল, কতদূর কৃতকার্য হইয়াছে বলা যায় না, কিন্তু এই শিক্ষাটি স্থায়ীভাবে হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়াছে যে, সুন্দর ভাষা কাব্যসৌন্দর্যের একটি প্রধান অঙ্গ ; ছন্দে এবং ভাষায় সর্বপ্রকার শৈথিল্য কবিতার পক্ষে সাংঘাতিক । এই প্রসঙ্গে আমার সেই কাব্যগুরুর নিকট আর-একটি ঋণ স্বীকার করিয়া লই । বাল্যকালে “বাল্মীকি-প্ৰতিভা’ নামক একটি গীতিনাট্য রচনা করিয়া “বিদ্বজনসমাগম”-নামক সম্মিলন উপলক্ষে অভিনয় করিয়াছিলাম । বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যান্য অনেক রসজ্ঞ লোকের নিকট সেই ক্ষুদ্র নাটকটি প্রীতিপ্ৰদ হইয়াছিল। সেই নাটকের মূল ভাবটি, এমনকি, স্থানে স্থানে তাহার ভাষা পর্যন্ত বিহারীলালের সারদামঙ্গলের আরম্ভভাগ হইতে গৃহীত। আজ কুড়ি বৎসর হইল সারদামঙ্গল আৰ্যদর্শন পত্রে এবং ষোলো বৎসর হইল পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়াছে ; ভারতী পত্রিকায় কেবল একটিমাত্র সমালোচক ইহাকে সাদর সম্ভাষণ করেন । তাহার পর হইতে “সারদামঙ্গল এই ষোড়শ বৎসর অনাদৃতভাবে প্রথম সংস্করণের মধ্যেই অজ্ঞাতবাস যাপন করিতেছে। কবিও সেই অবধি আর বাহিরে দর্শন দেন নাই। যিনি জীবনরঙ্গভূমির নেপথ্যে হইয়া সাধারণের বিদায়সম্ভাষণ প্রাপ্ত হইলেন না ; কিন্তু এ কথা সাহসপূর্বক বলিতে পারি, সাধারণের পরিচিত কণ্ঠস্থ শতসহস্র রচনা যখন বিনষ্ট এবং বিস্মৃত হইয়া যাইবে ‘সারদামঙ্গল তখন লোকস্মৃতিতে প্রত্যহ উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিবে এবং কবি বিহারীলাল যশঃস্বগে অস্নান বরমাল্য ধারণ করিয়া বঙ্গসাহিত্যের অমরগণের সহিত একাসনে বাস করিতে থাকিবেন । আষাঢ় ১৩০১ সঞ্জীবচন্দ্ৰ পালামেী কোনো কোনো ক্ষমতাশালী লেখকের প্রতিভায় কী একটি গ্ৰহদোষে অসম্পূর্ণতার অভিশাপ থাকিয়া যায় ; তাহারা অনেক লিখিলেও মনে হয় তাহাদের সব লেখা শেষ হয় নাই। তঁহাদের প্রতিভাকে আমরা সুসংলগ্ন আকারবদ্ধভাবে পাই না ; বুঝিতে পারি তাহার মধ্যে বৃহত্ত্বর মহত্ত্বের অনেক উপাদান ছিল, কেবল সেই সংযোজনা ছিল না। যাহার প্রভাবে সে আপনাকে সর্বসাধারণের নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে প্রকাশ ও প্রমাণ করিতে পারে । সঞ্জীবচন্দ্রের প্রতিভা পূর্বোক্ত শ্রেণীর। র্তাহার রচনা হইতে অনুভব করা যায় তাহার প্রতিভার অভাব ছিল না, কিন্তু সেই প্রতিভাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাহার হাতের কাজ দেখিলে মনে হয়, তিনি যতটা কাজে দেখাইয়াছেন। তঁহার সাধ্য তদপেক্ষা অনেক অধিক ছিল । তাহার মধ্যে যে পরিমাণে ক্ষমতা ছিল সে পরিমাণে উদ্যম ছিল না । তাহার প্রতিভার ঐশ্বৰ্য ছিল। কিন্তু গৃহিণীপনা ছিল না। ভালো গৃহিণীপনায় স্বল্পকেও যথেষ্ট করিয়া