পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(68 রবীন্দ্র-রচনাবলী তুলিতে পারে ; যতটুকু আছে তাহার যথাযোগ্য বিধান করিতে পারিলে তাহার দ্বারা প্রচুর ফল পাওয়া গিয়া থাকে। কিন্তু অনেক থাকিলেও উপযুক্ত গৃহিণীপনার অভাবে সে ঐশ্বৰ্য বার্থ হইয়া যায় ; সে-স্থলে অনেক জিনিস ফেলাছড়া যায় অথচ অল্প জিনিসই কাজে আসে। তঁহার অপেক্ষা অল্প ক্ষমতা লইয়া অনেকে যে পরিমাণে সাহিত্যের অভাব মোচন করিয়াছেন তিনি প্রচুর ক্ষমতা সত্ত্বেও তাহা পারেন নাই ; তাহার কারণ সঞ্জীবের প্রতিভা ধনী, কিন্তু গৃহিণী নহে। একটা উদাহরণ দিলেই পাঠকগণ আমার কথাটা বুঝিতে পরিবেন। “জাল প্রতাপচাদ। --নামক গ্রন্থে । সঞ্জীবচন্দ্ৰ যে ঘটনাসংস্থান, প্রমাণবিচার এবং লিপিনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়াছেন, বিচিত্র জটিলতা ভেদ করিয়া যে-একটি কৌতুহলজনক আনুপূর্বিক গল্পের ধারা কাটিয়া আনিয়াছেন তাহাতে তাহার অসামান্য ক্ষমতার প্রতি কাহারও সন্দেহ থাকে না- কিন্তু সেইসঙ্গে এ কথাও মনে হয়। ইহা ক্ষমতার অপব্যয় মাত্র । এই ক্ষমতা যদি তিনি কোনো প্রকৃত ঐতিহাসিক ব্যাপারে প্রয়োগ করিতেন তবে তাহা আমাদের ক্ষণিক কৌতুহল চরিতার্থনা করিয়া স্থায়ী আনন্দের বিষয় হইত। যে কারুকার্য প্রস্তরের উপর খোদিত করা উচিত তাহা বালুকার উপরে অঙ্কিত করিলে কেবল আক্ষেপের উদয় হয়। ‘পালামীে সঞ্জীবের রচিত একটি রমণীয় ভ্রমণবৃত্তান্ত । ইহাতে সৌন্দর্য যথেষ্ট আছে, কিন্তু পড়িতে পড়িতে প্রতিপদে মনে হয় লেখক যথোচিত যত্নসহকারে লেখেন নাই। ইহার রচনার মধ্যে অনেকটা পরিমাণে আলস্য ও অবহেলা জড়িত আছে, এবং তাহা রচয়িতারও অগোচর ছিল না । বঙ্কিমবাবুর রচনায় যেখানেই দুর্বলতার লক্ষণ আছে সেইখনেই তিনি পাঠকগণকে চােখ রাঙাইয়া দাবাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়াছেন- সঞ্জাববাবু অনুরূপ স্থলে অপরাধ স্বীকার করিয়াছেন, কিন্তু সেটা কেবল পাঠকদের মুখ বন্ধ করিবার জন্য— তাহার মধ্যে অনুতাপ নাই এবং ভবিষ্যতে যে সতর্ক হইবেন। কথার ভাবে তাহাও মনে হয় না। তিনি যেন পাঠকদিগকে বলিয়া রাখিয়াছেন, “দেখো বাপু, আমি আপন ইচ্ছায় যাহা দিতেছি। তাঁহাই গ্রহণ করো, বেশি মাত্রায় কিছু প্ৰত্যাশা করিয়ো না ’ । ‘পালামীে-ভ্রমণবৃত্তান্ত তিনি যে ছাদে লিখিয়াছেন, তাহাতে প্ৰসঙ্গক্রমে আশপাশের নানা কথা আসিতে পারে- কিন্তু তবু তাহার মধ্যেও নির্বাচন এবং পরিমাণসামঞ্জস্যের আবশ্যকতা আছে। যে-সকল কথা আসিবে তাহারা আপনি আসিয়া পড়িবে, অথচ কথার স্রোতকে বাধা দিবে না। ঝর্না যখন চলে তখন যে পাথরগুলাকে স্রোতের মুখে ঠেলিয়া লইতে পারে তাহাকেই বহন করিয়া লয়, যাহাকে অবাধে লঙঘন করিতে পারে তাহাকে নিমগ্ন করিয়া চলে, আর যে পাথরটা বহন বা লঙ্ঘন -যোগ্য নহে তাহাকে অনায়াসে পাশ কাটাইয়া যায়। সঞ্জাববাবুর এই ভ্ৰমণকাহিনীর মধ্যে এমন অনেক বক্তৃতা আসিয়া পড়িয়াছে যাহা পাশ কাটাইবার যোগ্য, যাহাতে রসের ব্যাঘাত করিয়াছে এবং লেখকও অবশেষে বলিয়াছেন, ‘এখন এ-সকল কচুকচি যাক।” কিন্তু এই সকল কচুকচিগুলিকে সযত্নে বর্জন করিবার উপযোগী সতর্ক উদ্যম তাহার স্বভাবতই ছিল না। যে কথা যেখানে আসিয়া পড়িয়াছে অনাবশ্যক হইলেও সে কথা সেইখানেই রহিয়া গিয়াছে । যেজন্য সঞ্জীবের প্রতিভা সাধারণের নিকট প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারে নাই আমরা উপরে তাহার কারণ ও উদাহরণ দেখাইতেছিলাম, আবার যেজন্য সঞ্জীবের প্রতিভা ভাবুকের নিকট সমাদরের যোগ্য তাহার কারণও যথেষ্ট আছে । ‘পালামীে-ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে সৌন্দর্যের প্রতি সঞ্জীবচন্দ্রের যে-একটি অকৃত্রিম সজাগ অনুরাগ প্রকাশ পাইয়াছে এমন সচরাচর বাংলা লেখকদের মধ্যে দেখা যায় না। সাধারণত আমাদের জাতির মধ্যে একটি বিজ্ঞাবার্ধক্যের লক্ষণ আছে- আমাদের চক্ষে সমস্ত জগৎ যেন জরাজীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সৌন্দর্যের মায়া-আবরণ যেন বিস্রস্ত হইয়াছে, এবং বিশ্বসংসারের অনাদি প্রাচীনতা পৃথিবীর মধ্যে কেবল আমাদের নিকটই ধরা পড়িয়াছে। সেইজন্য অশািনবসন ছন্দভাষা আচারব্যবহার বাসস্থান সর্বত্রই সৌন্দর্যের প্রতি আমাদের এমন সুগভীর অবহেলা । কিন্তু সঞ্জীবের অন্তরে সেই জরার রাজত্ব ছিল না। তিনি যেন একটি নূতনসৃষ্ট জগতের মধ্যে একজোড়া নূতন চক্ষু লইয়া ভ্ৰমণ করিতেছেন। ‘পালামীেতে সঞ্জীবচন্দ্ৰ যে বিশেষ কোনো কৌতুহলজনক নূতন কিছু দেখিয়াছেন, অথবা